আমাদের জীবন আদর্শের বাতিঘর অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান। যিনি ইবনে সাজ্জাদ নামেও পরিচিত। আজ ১৪ আগস্ট, ২০২৫, সেই আলোকবর্তিকার জন্মদিন। জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯৪০ সালের এই দিনে, এবং আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন ১৪ নভেম্বর ২০১৩-তে। বিনম্র শ্রদ্ধায় আজ স্মরণ করছি সেই মহামানবকে — অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান, যিনি ইবনে সাজ্জাদ নামেও আমাদের হৃদয়ে অমর হয়ে আছেন।
অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান ছিলেন কেবল একজন শিক্ষক বা প্রশাসক নন, তিনি ছিলেন এক যুগান্তকারী আলোকিত মানুষ। নির্মলচন্দ্র ঘোষ নামের এক তরুণ থেকে শুরু করে হয়ে উঠেছিলেন মোহাম্মদ হোসেন খান, অতঃপর লেখক-পরিচয়ে পরিচিত হন ‘ইবনে সাজ্জাদ’ নামে। তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় যেন এক একটি ইতিহাসের অংশ — তিনি নিজেই হয়ে উঠেছিলেন এক জীবন্ত ইতিহাস।
শিক্ষাবিস্তার, মানবিক সমাজ গঠন, চিন্তাশীল প্রজন্ম গড়ায় তাঁর অবদান ছিল অসামান্য। হাজারো ছাত্র তাঁর কাছ থেকে পেয়েছে দিকনির্দেশনা, শিখেছে কিভাবে মানুষ হতে হয়। বাংলার প্রবাদপ্রতিম রাজনৈতিক গুরু মজলুম জননেতা হযরত মাওলানা ভাসানীর স্নেহধন্য ছিলেন তিনি। তাঁর চিন্তা-চেতনায় প্রভাব ফেলেছে সাহাবী হযরত আবুজর গিফফারী (রাহঃ)-এর জীবনাদর্শ, যা তিনি গভীর শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠার সঙ্গে ধারণ করতেন।
অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খানের সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার পরিধিও ছিল অসীম। দেওয়ান হাসন রাজা থেকে শুরু করে আল্লামা রুমী, হাফিজ, সিরাজী, ইকবাল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, এমনকি সেক্সপিয়ার — সকলের সাহিত্য তাঁর কণ্ঠে যেন ছিল জীবন্ত। মুখস্ত আবৃত্তি করতেন কবিতা, ব্যাখ্যা দিতেন অর্থপূর্ণভাবে। নিজের পাঠাগার গড়ে তুলেছিলেন শুধু নয়, বই সংরক্ষণের জন্য আলাদা বাসাও ভাড়া করেছিলেন চকবাজারে। এই গ্রন্থাগারের তালিকা তৈরির দায়িত্ব দিয়েছিলেন আমার ছোট ভাই আবদুর রসুলকে, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই কাজ শেষ হওয়ার আগেই স্যার ইন্তেকাল করেন।
দৈনিক আজাদীতে তাঁর লেখার পরিমাণ ছিল হাজার ছাড়িয়ে। সমাজ, ইতিহাস, সাহিত্য, নীতি ও মূল্যবোধ—সব বিষয়ে তাঁর লেখাগুলো ছিল সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে। তিনি ছিলেন আমাদের স্যার, আমাদের প্রেরণার বাতিঘর, পথপ্রদর্শক। আজকের দিনটিকে আরও বিশেষ করে তুলেছে এই কারণে যে, এই একই দিন জন্মগ্রহণ করেছিলেন বাংলা ব্যান্ডসংগীতের কিংবদন্তি শিল্পী শাফিন আহমেদ, যিনি কিছু মাস আগেই প্রয়াত হয়েছেন। এই দুই আলোকিত মানুষের প্রতি আজকের দিনে শ্রদ্ধা জানানো আমাদের সাংস্কৃতিক ও মানবিক দায়িত্ব। মুহাম্মদ হোসেন খান স্যার এখন পরপারে, চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন কাপাসগোলা জামতলা মসজিদের কবরস্থানে। তিনি নিজেই বলতেন, “মাটির বিছানা বড়ই আরাম।” সেই আরামে থাকুন স্যার, শান্তিতে থাকুন। তাঁর জন্মদিনে তাঁকে শ্রদ্ধা, ভালবাসা আর কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করছি। ইবনে সাজ্জাদ কেবল একজন ব্যক্তি ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক চলমান বিশ্ববিদ্যালয়, এক আদর্শ—যার আলো আমাদের পথ দেখাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
লেখক: সভাপতি, চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্র, বাংলাদেশ।