মাওলানা আকরম খাঁর মৃত্যু দিবস। বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি তাঁর রেখে যাওয়া কর্ম ও আদর্শকে। উপমহাদেশের ইতিহাসে এমন কিছু মনীষী আছেন, যাঁদের অবদান নিঃসন্দেহে যুগান্তকারী হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের নাম অনেকটাই আড়ালে চলে গেছে। তেমনই একজন আড়ালের সূর্য হলেন আমাদের মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ। তিনি ছিলেন একাধারে সাংবাদিক, রাজনীতিক, সাহিত্যিক ও একজন বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ। তাঁর জীবন ও কর্ম বাংলা মুসলমান সমাজের জাগরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। তিনি যে শুধু একজন পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তা নয়, তিনি ছিলেন সমাজ রূপান্তরের এক বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর।
মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ ১৮৬৮ সালের ৭ জুন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনা জেলার হাকিমপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আলহাজ গাজী আব্দুল বারি খাঁ এবং মাতা বেগম রাবেয়া খাতুন। প্রারম্ভিক শিক্ষা সমাপ্ত করে তিনি রাজ্যের প্রধান শহর কলকাতায় চলে যান এবং সেখানে তিনি সাহিত্য, ধর্ম ও রাজনীতির প্রতি আগ্রহী হয়ে জাতির সূর্যসন্তান হয়ে উঠেছিলেন।
মাওলানা আকরম খাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হল সাংবাদিকতা। তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত পত্রিকাগুলোর মধ্যে মোহাম্মদী, খাদেম, সেবক, এবং সর্বোপরি দৈনিক আজাদ উল্লেখযোগ্য।
১৯১০ সালে তিনি সাপ্তাহিক মোহাম্মদী ও দৈনিক খাদেম নামে দুটি পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২১ সালে তিনি উর্দু জামানা ও বাংলা দৈনিক সেবক প্রকাশ করেন। এরপর ১৯২৭ সালে পুনরায় মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকাটি প্রকাশ করেন, যা ১৯৭০ সাল পর্যন্ত চালু ছিল।
১৯৩৬ সালে তিনি মুসলিম সমাজকে জাগ্রত করার লক্ষ্যে প্রকাশ করেন দৈনিক আজাদ। এটি ছিল শুধু একটি পত্রিকা নয়, এটি ছিল মুসলিম চিন্তা-চেতনা, আত্মপরিচয় ও রাজনৈতিক অধিকারের একটি বাহক। ব্রিটিশ শাসনামল, পাকিস্তান পর্ব এবং স্বাধীন বাংলাদেশের সূচনালগ্ন পর্যন্ত এই পত্রিকার ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল। তাঁর সাংবাদিকতা ছিল আদর্শনিষ্ঠ, বস্তুনিষ্ঠ এবং জাতি গঠনের লক্ষ্যে নিবেদিত।
মাওলানা আকরম খাঁ রাজনীতিতেও সক্রিয় ছিলেন। তিনি অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের অন্যতম সদস্য ছিলেন এবং পূর্ব বাংলার মুসলিমদের অধিকারের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময়ও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।
১৯৬২ সালে গঠিত পাকিস্তান কাউন্সিল অব ইসলামিক আইডিয়োলজি-এর তিনি ছিলেন একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, যা প্রমাণ করে ইসলামী চিন্তাধারার বিস্তার ও প্রয়োগে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি কতটা অগ্রসর ছিল।
তিনি কেবল রাজনীতি ও সাংবাদিকতার মানুষ ছিলেন না, সাহিত্য ও ধর্মীয় চিন্তাতেও ছিলেন এক ব্যতিক্রমধর্মী ব্যক্তিত্ব। তাঁর লেখনিতে ফুটে উঠেছে সমাজের অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, ইসলামী আদর্শের প্রচার এবং জাতি গঠনের প্রয়োজনীয় বার্তা। মুসলিম পুনর্জাগরণের লক্ষ্যে তিনি লিখেছেন, চিন্তা করেছেন, মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তাঁর লেখা, অনুবাদ ও সম্পাদিত ধর্মীয় বিষয়ক বই ও প্রবন্ধসমূহ সেই সময়ের বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে সচেতনতা ও আগ্রহ সৃষ্টি করে।
১৮ আগস্ট ১৯৬৮ সালে এই মহান মনীষী ইন্তেকাল করেন। ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে আমরা যখন তাঁকে স্মরণ করি, তখন প্রশ্ন ওঠে—আমরা কি যথাযথভাবে তাঁকে মূল্যায়ন করছি? তাঁর অবদান কি যথার্থ মর্যাদা পাচ্ছে ইতিহাসে? দুঃখজনকভাবে, উত্তরটা অনেক ক্ষেত্রেই ‘না’।আমরা যদি আমাদের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করতে চাই, তবে আকরম খাঁদের মতো মনীষীদের যথার্থভাবে স্মরণ ও মূল্যায়ন করতে হবে। স্কুল-কলেজের পাঠ্যক্রমে তাঁদের অবদান অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং মিডিয়া, গবেষণা ও আলোচনায় তাঁদের কর্মকাণ্ডকে বারবার সামনে নিয়ে আসতে হবে।
মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ ছিলেন এমন একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব, যিনি সাংবাদিকতা, রাজনীতি, সাহিত্য ও ধর্ম—সব ক্ষেত্রেই নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন জাতির জন্য। তাঁর জীবন ছিল ত্যাগ, সংগ্রাম ও আদর্শের প্রতীক।
তথ্যের জন্য ঋণস্বীকার: ইতিহাসবিশারদ আলহাজ আজিজুল হক রচিত ' কালজয়ী পুরুষ মাওলানা আকরম খাঁ ' , বাক্যচর্চা, ১৪ আলিমুদ্দিন স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০১৪, জুন ২০০২, ভারত।
লেখক:
সভাপতি, মুসলিম হিস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ।