মানুষ আছে কিন্তু মানুষের মুখ নাই অর্থাৎ মুখে বুলি নাই। দুনিয়ার এমন চিত্র কল্পনার পথেও বাধাপ্রাপ্ত হই। মানুষের মন আছে, মনের কথা আছে। যা প্রকাশিত হয় মুখগহ্বর দ্বারা। তাইতো বলা হয়ে থাকে “মানুষের মনের ভাব প্রকাশের প্রধান মাধ্যম হলো ভাষা।” তবে পৃথিবীর সমস্ত ভাষা আঞ্চলিক ভাষার উপর ভর করেই বেড়ে ওড়ে। আঞ্চলিক ভাষা হল “একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলের মানুষের কথ্য ভাষা, যা সেই অঞ্চলের বাইরে খুব বেশি পরিচিত নয়।” এটি একটি এলাকার মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত ভাষা, এবং এর নিজস্ব শব্দভান্ডার, উচ্চারণরীতি ও ব্যাকরণ থাকতে পারে।
আপনি নির্দিষ্ট একটা এলাকার মানুষ, সেই এলাকার মানুষের সাথেই তো আপনার কথাবার্তা, ওঠাবসা বেশি হয়ে থাকে। এর বাইরে অন্য জেলার মানুষের সাথে যখন আপনার যোগাযোগ হয় তখন তিনিও যদি তার আঞ্চলিক ভাষার মাধ্যমে আপনার সাথে কথা বলা আরম্ভ করেন, তা হয়তো আমি নাও বুঝতে পারেন। এখানে একটা ভাষার আশ্রয়ে আমাদের যেতে হয়, তা হল কেন্দ্রীয় ভাষা, মান ভাষা অথবা প্রমিত ভাষা।
ইন্টারনেটের তথ্য মতে পৃথিবীতে প্রায় ৭,১০০টিরও বেশি ভাষা প্রচলিত আছে। চাটগাঁইয়া ভাষা, যা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষের ভাষা, বিশ্বের সর্বাধিক কথিত ভাষাগুলোর মধ্যে ৮৮তম স্থানে রয়েছে। এই ভাষায় প্রায় ১ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ কথা বলে বলে।
চট্টগ্রামের ভাষার গান সবচেয়ে জনপ্রিয়। শেফালী ঘোষ ও শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব’র গাওয়া গান একটা সময় বেশি সমাদৃত হয়েছিল। নাতিন বরই খা, কীরে ঔডা কী গল়লি, কাঞ্চনি তুই এমুই আয়, কর্ণফুলিরে সাক্ষী রাখিলাম তোরে, অ ও বানু বানুরে, আঁরে কতঅ ভারাইবা ইত্যাদি এই গানগুলো চট্টগ্রামের মানুষের মুখে মুখে তো ছিলই অন্য জেলার মানুষও গাইত। অন্য শিল্পীর গাওয়া বহু গানও যথেষ্ট বিখ্যাত হয়েছে, যেমন আমরা বলতে পারি, ওরে সাম্পানওয়ালা, কইলজার ভুতুর গাঁথি রাইক্ষুম তোঁয়ারে, মধু হই হই আঁরে বিষ খাওয়াইলা, ও জেডা ফইরের বাপ, গিরেইল্লা কচুল্লতি, ছোডঅ ছোডঅ ঢেউ তুলি, অ ভাই আঁরা চাটগাঁইয়া নওজোয়ান ইত্যাদি।
এবার আসি চাটগাঁইয়া কবিতার বিষয়ে, চাটগাঁইয়া কবিতার পরিসরও দিনদিন ক্রমবর্ধমান হারে বেড়েই চলেছে। আমি প্রথম চাটগাঁইয়া কবিতা পড়ি ফটিকছড়ির স্বনামধন্য কবি আফছার উদ্দিন আহাম্মদ চৌধুরী “চাটগাঁইয়া ছড়া” নামের বই থেকে। “আন্নগরিচ লানিজুনি ইস্কুলুত যাগৈ ননাইয়ে/ তোল্লায় বুলি থিইয়েই রইয়ি ইমা সীমা মনাইয়ে” এই ছড়া পড়ে বেশি পুলকিত হয়েছিলাম। চাটগাঁ ভাষায় তার লেখা বই দুটি,
“এক বৈঅমত দুই ডইল্লে আচার” এবং “এক বৈঅমত তিন ডইল্লে আচার”। একটা কথা বলে রাখি, ছড়া সব কবিতাও তবে সব কবিতা ছড়া নয়। পরবর্তীতে ফটিকছড়ি কৃতি সন্তান জনপ্রিয় সুসাহিত্যিক উৎপলকান্তি বড়ুয়ার লেখার সাথে পরিচয়, তিনি লিখেছেন, “অবুকরে বুক্ বুক্” এবং “আফুডাইগ্যা”। বাঙলাদেশের কিংবদন্তী ছড়াকার সুকুমার বড়ুয়া, তিনি লিখেছেন “কোয়াল খাইয়ে” এটাও একটা অনন্য সাধারণ গন্থ।
যে ভাষা মানুষের মনমস্তিস্কে নিত্য বীজ বপন করে এবং যে ভাষা মানুষের মুখে মুখে হয়ে যায়, যে ভাষায় বহু ছড়া-কবিতা, শ্লোক, গান লেখা হয়ছে এবং যে ভাষার শেকড় অনেক গভীরে সে ভাষা হারিয়ে যেতে পারে না।
চাটগাঁইয়া ছড়া-কবিতা বেশি বেশি চর্চার জন্য “চেরাগ” প্রকাশ করছে(অনলাইনে-অফলাইনে) চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ছড়া সংকলন-চেরাগ, আয়োজন করছে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ছড়া উৎসব, ছড়া প্রদর্শনী এবং চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ছড়ার আড্ডা। আর এর নেপথ্যে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক উৎপলকান্তি বড়ুয়া।
গত ১৬ আগস্ট ২০২৫ বিকেল সাড়ে চারটায় উৎপলকান্তি বড়ুয়ার সঞ্চালনায় ”চেরাগ” এর প্রথম আঞ্চলিক ছড়া পাঠের আড্ডা অনুষ্ঠিত হয় ডিসি হিলের খোলা প্রাঙ্গনে। সভাপতিত্ব করেন শিশুসাহিত্যিক দীপক বড়ুয়া। ছড়ার আলোচনা করেন শিশুসাহিত্যিক ও নাট্যব্যক্তিত্ব সনজীব বড়ুয়া। ছড়া পাঠে অংশ নেন দীপক বড়ুয়া, সনজীব বড়ুয়া, উৎপলকান্তি বড়ুয়া,
কেশব জিপসী, বাসুদেব খাস্তগীর, লিটন কুমার চৌধুরী, বিভাস গুহ, বিপ্লব বড়ুয়া, বিকাশ বড়ুয়া, প্রদ্যোত কুমার বড়ুয়া, সাজেদুল করিম ভুঁইয়া, নবারুণ বড়ুয়া, কানিজ ফাতিমা প্রমুখ।
প্রেস বিজ্ঞপ্তি
Leave a Reply