মোহাম্মদ আলবিন
চট্টগ্রাম শহর থেকে কর্ণফুলি ব্রিজ পার হয়ে কুচকুচে কালো পিএবি সড়ক ধরে যেতে হবে দক্ষিণে।শিকলবাহা ক্রসিং এ গিয়ে ডান পথে ফকিরনীর হাট হয়ে বড়উঠান হয়ে চাতরী চৌমুখনি বাজার। বাজার থেকে একটু দক্ষিণে কালবি দিঘির মোড়। এই তো এসে গেলেন, দিঘির পশ্চিমেই কালাবিবি চৌধুরানীর বাড়ি, গ্রামের নাম বেলচূড়া। তিনিই হলেন মলকা-মনু উপাখ্যানের নায়ক মনু মিয়ার আপন বড় বোন কালাবিবি চৌধুরানী। তাঁর স্বামী রুস্তম আলী খাঁ বড়উঠানের প্রখ্যাত জমিদার দেওয়ান মনোহর আলী খান (দেওয়ান শ্যামরায়) এর সন্তান। রুস্তম আলী খাঁ’র অপর পরিচয়, তিনি হলেন বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খানের কন্যার সন্তান বা নাতি। তারই স্ত্রী কালাবিবি। কালাবিবি ও মনু মিয়ার পিতা শেরমস্ত খাঁ। শেরমস্ত খাঁ ছিলেন আরাকান রাজ্যের চট্টগ্রামে আশ্রয় নেয়া বাংলা-বিহার-উড়িশ্যার নবাব শাহ সুজার অন্যতম এক সেনাপতি। অপরদিকে শেরমস্ত খাঁর পুত্র জবরদস্ত খাঁ প্রকাশ মনু মিয়া ছিলেন মোগল কর্তৃক চট্টগ্রাম বিজয়ের প্রধান সেনাপতি উমেদ খাঁ’র সহযোদ্ধা ও সেনাপতি। পিতা শেরমস্ত খাঁ’র মৃত্যুর পর বিশাল জমিদারি দেখাশুনার দায়িত্ব পালনের ভার ন্যস্ত হয় কালাবিবি চৌধুরানির ওপর। কারণ একমাত্র ছোটভাই জবরদস্ত খাঁ’র (মনুমিয়া) সৌখিন ও উশৃঙ্খল জীবনযাপনে জমিদারি পরিচালনায় তিনি ভাইয়ের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। মনুমিয়াকে পরমার্শদাতা ও শাসনকর্তা হিসেবে কালাবিবি চৌধুরানি এবং তার স্বামী রুস্তম আলী খাঁ’ই ছিলেন অবিভাবক। রুস্তম আলী খাঁ অত্যন্ত ধার্মিক ও দানশীল ব্যক্তি ছিলেন। জনস্বার্থে তিনি বটতলী গ্রামে হযরত শাহ মোহছেন আউলিয়ার মাজারকে কেন্দ্র করে বিশাল এক বাজার প্রতিষ্ঠা করেন। ‘রুস্তম আলী হাট’ নামক প্রসিদ্ধ বাজারটি আজও তারই কীর্তি বহন করে আসছে।
মনুমিয়ার মৃত্যুর পর অত্যন্ত বিচক্ষনতার সাথে জমিদারী দেখাশোনা করতেন কালাবিবি চৌধুরানী। একজন মহিলা কর্তৃক বিশাল জমিদারী পরিচালনার কৃতিত্ব দেখে নজর পড়ে বৃটিশ সরকারের। বৃটিশ শাসনামলের শুরুর দিকে ১৭৬৫ সালে জনৈক বৃটিশ রাজস্ব কর্মকর্তা একদল সফরসঙ্গী নিয়ে দেয়াঙ বা আজকের আনোয়ারার বেলচূড়া গ্রামে আসেন কালাবিবি চৌধুরানীর সাথে দেখা করতে। বৃদ্ধা ধর্মভীরু কালাবিবি চৌধুরানী বিধর্মী বৃটিশ কর্মকর্তার সাথে দেখা করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। কথিত আছে যে, উক্ত বৃটিশ কর্মকর্তা সফরসঙ্গী সহ কালাবিবি চৌধুরানীর দিঘির পাড়ে তাবু ফেলে সাতদিন অপেক্ষা করলেও কালাবিবি চৌধুরানী তাদের সাথে দেখা করেননি। ফলে বৃটিশ কর্মকর্তা ক্ষুব্ধ হয়ে কলকাতা ফিরে যান এবং এক সরকারি আদেশে বিশাল জমিদারীর অধিকাংশই বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করেন। তারপরও কালাবিবি চৌধুরানী বৃটিশ প্রশাসনের শরণাপন্ন হননি। ফলে আরো ক্ষুব্ধ হয়ে অতিমাত্রায় খাজনা ধার্য এবং খাজনা আদায়ে বৃটিশ সৈন্য প্রেরণ করেন কালাবিবি চৌধুরীর বাড়িতে। বৃটিশ সৈন্য কালাবিবি চৌধুরানী বিশাল বাহিনীর প্রতিরোধ ব্যুহ দেখে ফিরে যেতে বাধ্য হন এবং আইনী লড়াইয়ে তিনি জিতে যান। অত্যন্ত বুদ্ধিমতি জমিদার কালাবিবি চৌধুরানী বিশাল জমিদারী পরিচালনায় তার দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তার খ্যাতি ছিল।তাঁর স্বামী রুস্তম আলী খাঁ’ও বড়উঠানের প্রসিদ্ধ জমিদার পিতা দেওয়ান মনোহর আলী খানের জমিদারী দেখাশোনা করতেন। মনুমিয়া ও কালাবিবি চৌধুরানীর ঔরষেও কোন সন্তান-সন্ততি ছিল না। সাতকানিয়া থানার বাজালিয়া গ্রাম থেকে উচ্চ বংশীয় খোদাবক্স নামক এক ছেলেকে পালক পুত্র হিসেবে গ্রহন করেন কালাবিবি চৌধুরানী। কথিত মতে, খোদাবক্স খান কালাবিবির বড়বোন বুড়া বিবি চৌধুরানীর সন্তান। নিঃসন্তান বোনকে সন্তান দান করে জমিদারী রক্ষাই ছিল পালকপুত্র বিনিময়ের অন্যতম কারণ। বর্তমানে কালাবিবি চৌধুরানীর বাড়িতে বসবাসরত বা কালাবিবি চৌধুরানীর পালকপুত্র বুড়া বিবি চৌধুরানীর পুত্র খোদাবক্স এর বংশধর। খোদাবক্স চৌধুরীর একমাত্র ছেলের নাম এহসান আলী চৌধুরী। এহসান আলী চৌধুরীর ৩ ছেলে ও ৪ কন্যা। তিনপুত্রের মধ্যে জান আলী চৌধুরী, সুজত আলী চৌধুরী, মকবুল আলী চৌধুরী। চার মেয়ের নাম জানা যায়নি।