চট্টলতত্ত্ববিদ পণ্ডিত আবদুল হক চৌধুরী (জন্ম: ২৪ আগস্ট ১৯২২ — মৃত্যু: ২৬ অক্টোবর ১৯৯৪)। তিনি আমাদের চট্টগ্রামের ইতিহাসের এক উজ্জ্বল আলোকস্তম্ভ, ইতিহাসপ্রেমী ও গবেষকদের চিরপ্রেরণার উৎস। তিনি আমাদের চট্টগ্রামের ইতিহাসের বাতিঘর হিসেবে সমধিক পরিচিত। চট্টগ্রামের অতীত, ঐতিহ্য, সমাজ, সংস্কৃতি ও জনজীবনের প্রায় প্রতিটি দিক তাঁর অনুসন্ধানী কলমে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। তাঁর রচিত অমূল্য গ্রন্থাবলি এই প্রজন্ম ও আগামীর প্রজন্মকে হাজার বছর পথ দেখাবে— ইতিহাস ও ঐতিহ্যের আলোকরশ্মি হয়ে।
“যে জাতির ইতিহাস নেই, তার ঐতিহ্যও নেই।”—এই কথাটি নিছক উচ্চারণমাত্র নয়; এটি এক জাতির আত্মপরিচয়, আত্মমর্যাদা ও ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনার মূলমন্ত্র। ইতিহাস মানে কেবল অতীতের বিবরণ নয়; ইতিহাস মানে জাতির সংগ্রাম, আত্মত্যাগ, চিন্তা ও চেতনার দলিল। যারা তাঁদের কর্ম, ত্যাগ, দেশপ্রেম ও চিন্তার মাধ্যমে এই ইতিহাসকে গড়ে তোলেন, তাঁরাই হয়ে ওঠেন জাতির দিশারী, জাতির বাতিঘর। তাঁদের স্মরণ মানেই নিজের শিকড়ের সন্ধান করা, নিজের ঐতিহ্যের মুখোমুখি দাঁড়ানো। আজ আমরা অনেকেই সেই ঐতিহ্যের স্রোতধারার বিপরীতে হেঁটে চলেছি; ইতিহাসের পাঠ থেকে দূরে সরে গিয়ে নবপ্রজন্ম বিপদগামিতার পথে পা বাড়াচ্ছে, যা কখনোই জাতির জন্য কল্যাণকর নয়। ইতিহাস ও ঐতিহ্যহীন পথচলা মানুষ ও সমাজ কোনোদিনই সুদূরপ্রসারী অগ্রগতি অর্জন করতে পারে না।পণ্ডিত আবদুল হক চৌধুরীর অনন্য অবদান হলো— তিনি প্রাচীন চট্টগ্রাম, সিলেট এবং আরাকান অঞ্চলের ইতিহাস নিয়ে গভীর গবেষণা করেন এবং বহু মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। বিশেষত চট্টগ্রামের নামের উৎপত্তি ও আদি ইতিহাসের যাবতীয় উৎস তিনি তাঁর গবেষণালব্ধ তথ্য ও দলিলনির্ভর লেখনিতে সুস্পষ্টভাবে উপস্থাপন করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহ: ১. চট্টগ্রামের ইতিহাস প্রসঙ্গ — প্রথম সংস্করণ (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড একত্রে): ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬, ২. চট্টগ্রামের ইতিহাস প্রসঙ্গ — দ্বিতীয় সংস্করণ: ১৯৮০, ৩. চট্টগ্রামের চরিতাভিধান — ডিসেম্বর ১৯৭৯, ৪. চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতি — ডিসেম্বর ১৯৮০, ৫. সিলেটের ইতিহাস প্রসঙ্গ — প্রথম সংস্করণ ১৯৮১, দ্বিতীয় সংস্করণ ১৯৯০, ৬. শহর চট্টগ্রামের ইতিকথা — এপ্রিল ১৯৮৫, ৭. চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতির রূপরেখা — বাংলা একাডেমি, মে ১৯৮৮, ৮. চট্টগ্রাম-আরাকান — জুন ১৯৮৯, ৯. চট্টগ্রামের ইতিহাসবিষয়ক প্রবন্ধ — নভেম্বর ১৯৯২, ১০. প্রাচীন আরাকান, রোহিঙ্গা, হিন্দু ও বড়ুয়া, বৌদ্ধ অধিবাসী — বাংলা একাডেমি, জানুয়ারি ১৯৯৪, ১১. বন্দর শহর চট্টগ্রাম — বাংলা একাডেমি, মে ১৯৯৪, ১২. প্রবন্ধ বিচিত্রা : ইতিহাস ও সাহিত্য — বাংলা একাডেমি, জুন ১৯৯৫।
তাঁর রচিত “চট্টগ্রামের ইতিহাস প্রসঙ্গ (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড)” এবং “চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতি” গ্রন্থ দুটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে পাঠ্যক্রমভুক্ত হয়েছিলো । দেশের ভেতরে ও বাইরে তাঁর রচনাবলি ইতিহাসবিদ, গবেষক ও পাঠক সমাজে ব্যাপক সাড়া ও সম্মান অর্জন করেছে। তাঁর স্মরণে বাংলা একাডেমি প্রকাশ করেছে “ঐতিহাসিক আবদুল হক চৌধুরী স্মারক গ্রন্থ”, যার সম্পাদক ড. মুহম্মদ মজির উদ্দিন মিয়া ও ড. তশিকুল ইসলাম। প্রকাশকাল: সেপ্টেম্বর ১৯৯৬। এছাড়া, প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ও প্রফেসর ইমেরিটাস ড. আবদুল করিম-এর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে “আবদুল হক চৌধুরী রচনাবলী”, যা ইতিহাস গবেষণায় এক অনন্য সংযোজন। আবদুল হক চৌধুরীর ইন্তেকালের পর তাঁরই মেয়ের জামাতা, পরবর্তীকালে বিচারপতি আবদুস সালাম মামুন ‘কিরাত’ নামক একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন, যেখানে আবদুল হক চৌধুরীর গবেষণাকর্ম ও প্রাচীন চট্টগ্রামের আদিনাম কিরাত সম্পর্কে ইতিহাস তুলে ধরা হয়।
চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্র ও ইতিহাসবিষয়ক লিটল ম্যাগাজিন “কিরাত বাংলা” তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বহু বছর ধরে আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। সুপ্রভাত রাউজান নামক একটি পত্রিকা ও সম্পাদক সম জিয়া উর রহমান-এর উদ্যোগে আয়োজিত বেশ কিছু সভায় আমিও অংশগ্রহণের সৌভাগ্য লাভ করেছি। এছাড়া, আবদুল হক চৌধুরী স্মৃতি সংসদ চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব ও জেলা পরিষদ মিলনায়তনে তাঁর স্মরণে আলোচনা সভার আয়োজন করেছে, যেখানে আমি প্রিয় গবেষক ও বড়ভাই পুঁথি গবেষক মোহাম্মদ ইসহাক চৌধুরী-এর আহ্বানে উপস্থিত থেকেছি বহুবার।আজ, ২৬ অক্টোবর ২০২৫, পণ্ডিত গবেষক আবদুল হক চৌধুরীর মৃত্যুবার্ষিকীতে আমরা বিনম্র শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি এই ইতিহাসতত্ত্ববিদকে, যিনি চট্টগ্রামের মাটি, মানুষ ও ঐতিহ্যের প্রতিটি অধ্যায়কে ইতিহাসের পাতায় স্থায়ী আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। তাঁর মতো একজন ইতিহাসগবেষক আমাদের সমাজে বিরল সম্পদ। তাঁর কর্ম ও চিন্তা আমাদের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে চিরকাল।
লেখক : সোহেল মো. ফখরুদ-দীন, সভাপতি, চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্র, পরিচালক ও সম্পাদক, দি একাডেমি অব হিস্ট্রি (ইতিহাসের পাঠশালা), চট্টগ্রাম,বাংলাদেশ।