মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ: স্বাধীনতার পথিকৃৎ ও গণতন্ত্রের আলোকবর্তিকা
-সোহেল মো.ফখরুদ-দীন
আমাদের জাতীগত ইতিহাস ও বাংলাদেশের ইতিহাসে যাঁদের ত্যাগ, আদর্শ ও সংগ্রামের মাধ্যমে জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটেছে, মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ২০ আগস্ট ২০২৫ তাঁর ৩৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। আজকের দিনে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি এই বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, সমাজসংস্কারক, ভাষাসংগ্রামী ও স্বাধীনতা আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্বকে। তিনি ছিলেন জাতির অন্তর্নিহিত চেতনার এক বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর, যিনি ব্রিটিশ শাসন থেকে শুরু করে পাকিস্তানি শাসন ও পরবর্তীকালে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন পর্যন্ত সক্রিয় ছিলেন।
মাওলানা তর্কবাগীশ ১৯০০ সালের ২৭ নভেম্বর সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া থানার তারুটিয়া গ্রামে এক ঐতিহাসিক পীর বংশে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম শাহ সৈয়দ আবু ইসহাক ও মাতার নাম আজিজুন্নেছা। শৈশব থেকেই তাঁর মাঝে ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মনোভাব। মাত্র ১৩ বছর বয়সে তিনি দুধ বিক্রেতাদের ন্যায্যমূল্য আদায়ে জমিদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দেন, যা তাঁর ভবিষ্যৎ সংগ্রামী জীবনের পূর্বাভাস দেয়।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালনে ১৯২২ সালের ২৭ জানুয়ারি সলঙ্গা হাটে মাওলানা তর্কবাগীশের নেতৃত্বে ‘বিলেতি পণ্য বর্জন’ আন্দোলন চলাকালে ব্রিটিশ পুলিশের গুলিতে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার নিরীহ মানুষ হতাহত হন। এই ঐতিহাসিক ঘটনা ‘সলঙ্গা হত্যাকাণ্ড’ নামে পরিচিত, যা উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক রক্তাক্ত অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে মাওলানা তর্কবাগীশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫৫ সালের ১২ আগস্ট পাকিস্তান গণপরিষদে তিনি প্রথমবারের মতো বাংলায় বক্তব্য দেন এবং দাবি তোলেন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার। তাঁর সেই ঐতিহাসিক বক্তব্য আজো ভাষা আন্দোলনের সংগ্রামী ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে।
আওয়ামী লীগ ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব: তিনি ছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগের দ্বিতীয় সভাপতি এবং পরে দীর্ঘ এক যুগ (১৯৫৬-১৯৬৭) বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি রাজনৈতিক অঙ্গনে সততা, সাহসিকতা ও দূরদর্শিতার জন্য সমাদৃত ছিলেন। রাজনীতি ছাড়াও মাওলানা তর্কবাগীশ ছিলেন একজন চিন্তাবিদ ও লেখক। তাঁর রচিত গ্রন্থসমূহ যেমন— শেষ প্রেরিত নবী, সত্যার্থে ভ্রমণে, ইসলামের স্বর্ণযুগের ছিন্ন পৃষ্ঠা, সমকালীন জীবনবোধ, স্মৃতির সৈকতে আমি, ইসমাইল হোসেন সিরাজী ইত্যাদি তাঁর জ্ঞানগম্ভীরতা ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় বহন করে। ১৯৮৬ সালের ২০ আগস্ট ঢাকার পিজি হাসপাতালে ৮৬ বছর বয়সে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর জীবন, আদর্শ ও কর্ম আজও প্রেরণার উৎস। তিনি শুধু একজন রাজনীতিবিদ নন, ছিলেন আদর্শবান মানুষ গঠনের কারিগর। মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ ছিলেন ইতিহাস নির্মাণকারী এক ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব। তাঁর জীবন ছিল দেশপ্রেম, সাহসিকতা, সততা এবং মানবিক মূল্যবোধে সমৃদ্ধ। আজ তাঁর ৩৯তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের দায়িত্ব হলো তাঁর আদর্শকে অনুসরণ করে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও সামাজিক সাম্যের সমাজ গঠনে সচেষ্ট হওয়া। জাতির ইতিহাসে তাঁর অবদান চিরভাস্বর থাকবে।
লেখক: সভাপতি, মুসলিম হিস্ট্রি এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ।