মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী : একজন অনন্য চিন্তাবিদ, সংগ্রামী মহাপুরুষ, সমাজসংস্কারক ও দার্শনিক
-সোহেল মো. ফখরুদ-দীন
রাজনৈতিক, শিক্ষা সম্পসারন, চট্টগ্রাম ও বঙ্গদেশের কল্যানে নিবেদিত মহাপুরুষ মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী চট্টগ্রামের প্রাচীন নামকে স্মরণ করতে নিজের নামের সাথে 'ইসলামাবাদ 'কে যুক্ত করেছিলেন। দেশ প্রেমের নজীর স্থাপনে অসীম অবদান রাখায় আজ চট্টগ্রাম বাসী কথায় কথায় মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর চট্টগ্রাম বলে গৌরব করেন। এই গৌরব ও সম্মান ইসলামাবাদী জনম জনম বহন করবে।। ইতিহাসে মাওলানা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী (১৮৭৫–১৯৫০) এমন এক বিস্ময়কর নাম, যিনি একইসাথে ছিলেন ইসলামি চিন্তাবিদ, জননেতা, সাংবাদিক, শিক্ষক, লেখক, দার্শনিক ও সমাজসংস্কারক। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, মানবপ্রেম ও আত্মত্যাগের প্রতীক এই অসাধারণ ব্যক্তি কেবল বাঙালি মুসলমান নয়, ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসেই ছিলেন এক প্রভাবশালী নেতৃত্বের প্রতীক।
১৮৭৫ সালের ২২শে আগস্ট চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া (বর্তমানে চন্দনাইশ) উপজেলার বরমা ইউনিয়নের আড়ালিয়ার চর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মাওলানা ইসলামাবাদী। পিতা মুন্সি মতিউল্লাহ পণ্ডিতের আদর্শে শিক্ষাজীবনের সূচনা হয়। পরবর্তীতে হুগলী ও কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে ‘টাইটেল’ ডিগ্রি অর্জন করে শিক্ষা জীবনে গতি আনেন। বাংলা, ইংরেজি, আরবি, ফারসি ও উর্দু ভাষায় তার পাণ্ডিত্য ছিল উল্লেখযোগ্য।
শিক্ষাজীবন শেষে তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন রংপুরের হারাগাছিয়া মাদ্রাসায় কিছুপরে সীতাকুণ্ড মাদ্রাসায় । এরপর বিভিন্ন মাদ্রাসায় অধ্যাপনার পাশাপাশি শিক্ষা বিস্তারে আত্মনিয়োগ করেন। উত্তরবঙ্গ ও চট্টগ্রামে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এতিমখানা ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেন সমাজের দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মুসলমানদের মাঝে।মাওলানা ইসলামাবাদী ছিলেন ভারতের জাতীয়তাবাদী ও স্বাধীনতা আন্দোলনের সাহসী সৈনিক। তিনি কংগ্রেসের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন, ১৯০৬ সালে প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সদস্য মনোনীত হন। ১৯২৩ সালে বেঙ্গল প্যাক্টের অন্যতম রচয়িতা হিসেবে তিনি পরিচিতি লাভ করেন। পরবর্তীতে কংগ্রেসের অহিংস নীতিতে আস্থা হারিয়ে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে ফরোয়ার্ড ব্লকে যোগ দেন এবং আজাদ হিন্দ ফৌজকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন ও সহায়তা করেন। এজন্য তাঁকে বহুবার কারাবরণ করতে হয় এবং অকল্পনীয় নির্যাতনের শিকার হতে হয় ব্রিটিশ কারাগারে।
বৃদ্ধ বয়সেও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেন। দেয়াং পাহাড় থেকে নেতাজীর সঙ্গে পুনঃসংযোগ স্থাপনের চেষ্টার সময় ব্রিটিশ সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করে লালকেল্লায় আটক রাখে এবং পরবর্তীতে পাঞ্জাবের ময়াওয়ালী জেলে পাঠায়। সেখানে তাঁকে অমানবিক নির্যাতনের মাধ্যমে তথ্য বের করার চেষ্টা করা হয়। তিনি আত্মজীবনীতে লিখেছেন, “পৃথিবীর কোন সভ্য জাতির ইতিহাসে এরকম ঘটনা ঘটতে পারে না। যা আমাকে জেল জীবনে করেছে "।
মাওলানা ইসলামাবাদী শিক্ষাকে জাতির মুক্তির চাবিকাঠি হিসেবে দেখতেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে চট্টগ্রামের কদম মোবারক এম ওয়াই উচ্চ বিদ্যালয়, কদম মোবারক মুসলিম এতিমখানা, বরকল এস জেড উচ্চ বিদ্যালয় অন্যতম। তিনি চট্টগ্রামের দেয়াং পাহাড়ে জাতীয় আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন এবং ৬০০ বিঘা জমি এই উদ্দেশ্যে সংগ্রহও করেন। যদিও জীবদ্দশায় এই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। তিনি একাধারে ৪২টিরও বেশি বইয়ের রচয়িতা। তাঁর গুরুত্বপূর্ণ রচনার মধ্যে রয়েছে – ভারতে মুসলিম সভ্যতা, সমাজ সংস্কার, ভূগোল শাস্ত্রে মুসলমান, ইসলাম জগতের অভ্যুত্থান, ভারতে ইসলাম প্রচার, সুদ সমস্যা, ইসলামী শিক্ষা, কোরআন ও বিজ্ঞান, এবং তিন খণ্ডে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে মুসলমানদের অবদান। পত্রিকা সম্পাদনায়ও তিনি ছিলেন অগ্রণী। তিনি সোলতান (১৯০১), দৈনিক হাবলুল মতিন (১৯১২), মোহাম্মদী (১৯০৩), কোহিনুর (১৯১১), বাসনা (১৯০৪) ও আল-এসলাম (১৯১৩)–এর মতো পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি সাংবাদিকতাকে সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী মজলুম জননেতা
মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানীর রাজনৈতিক শিক্ষক ও গুরু ছিলেন । তার চিন্তা-চেতনায় গড়ে ওঠা বহু আলেম, রাজনীতিক ও সমাজসংস্কারক পরবর্তীতে দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি ইসলামাবাদী উপাধি গ্রহণ করেছিলেন মুসলিম শাসনামলের চট্টগ্রামের নামানুসারে, যা ছিল তাঁর আত্মপরিচয়ের প্রতীক। ১৯৫০ সালের ২৪ অক্টোবর তিনি নিজ জন্মভূমি চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলার বরমা গ্রামে ইন্তেকাল করেন। বর্তমানে তিনি কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদের কবরস্থানে শায়িত আছেন।তার স্মৃতি ধরে রাখতে ও আদর্শের বাস্তবায়নে ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী গবেষণা পরিষদ, যেটি তাঁর ভাবনা ও স্বপ্ন বাস্তবায়নে আজও কাজ করে যাচ্ছে। এই সংগঠনের নেতৃত্বে ছিলেন সাংবাদিক সৈয়দ মোস্তফা জামাল ও ইতিহাস গবেষক সোহেল মোহাম্মদ ফখরুদ-দীন। মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী শুধু একজন মানুষ ছিলেন না, তিনি ছিলেন একটি চলমান আন্দোলনের নাম, এক অগ্নিশিখা, এক শিক্ষা, এক চেতনা। যিনি জীবনের প্রতিটি ধাপে দেশের মানুষের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। আজকের প্রজন্মের উচিত তার জীবন ও আদর্শ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আত্মনির্ভরশীল, নৈতিক ও মানবিক সমাজ গঠনে ব্রত হওয়া। তাঁর সংগ্রাম ও স্বপ্ন আমাদের আলোকবর্তিকা হয়ে থাকুক। ২০২৫ সালে ২২ আগস্ট এই মহা মনীষীর জন্মদিবসে বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
লেখক : সভাপতি, মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী গবেষণা পরিষদ ও সভাপতি, চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্র।