২০১৮ সালের জুলাই মাসের উত্তাল সময়ে দেশের ছাত্রসমাজের নেতৃত্বে রাজপথে যে অভূতপূর্ব আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল, তা আজ পূর্ণ করল সাত বছর। নিরাপদ সড়ক আন্দোলন (নিসআ) নামের সেই সামাজিক বিস্ফোরণ শুধু দুর্ঘটনার প্রতিবাদ নয়, ছিল এক বৃহৎ রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে প্রজন্মের তীব্র ধিক্কার। সময় গড়িয়েছে, সরকার আইন করেছে, প্রচারণাও হয়েছে, কিন্তু এখনও প্রতিদিন সড়কে ঝরে পড়ে মূল্যবান প্রাণ, অগণিত যাত্রী হয়রানির শিকার হয়।
এই প্রেক্ষাপটে, সাত বছরের মাথায় নিরাপদ সড়ক আন্দোলন আজ নতুনভাবে প্রশ্ন তোলে:
আমরা কি সত্যিই নিরাপদ?
এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য কি ভুলে গেছি আমরা?
আসলেই কি পরিবর্তন হয়েছে পরিবহন সেক্টরে?
❖ নিসআ: একটি আন্দোলন থেকে জনচেতনায় রূপান্তর
নিরাপদ সড়ক আন্দোলন প্রথম শুরু হয় দুটি কিশোর শিক্ষার্থীর মৃত্যুতে ক্ষুব্ধ হয়ে রাজপথে নামা সহস্র ছাত্রের হাত ধরে। এই আন্দোলনের কেন্দ্রে ছিল নিরাপদ সড়কের দাবি, চালকের লাইসেন্স যাচাই, ট্রাফিক শৃঙ্খলা নিশ্চিতকরণ, এবং শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি রূপ নেয় একটি স্থায়ী জনচেতনায়—যার নাম এখন নিসআ (নিরাপদ সড়ক আন্দোলন)। সাত বছরে নিসআ একটি প্রজন্মের চেতনার প্রতীক হয়ে উঠেছে, যারা জানে,
"নিরাপদ সড়ক পাওয়া আমার অধিকার, কোনো দয়া নয়।"
❖ সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ
আইনের প্রয়োগ নেই: সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবে এখনো পুরোপুরি প্রয়োগ হয়নি। রাজনৈতিক প্রভাবশালী মহল ও পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনের চাপেই তা ঝুলে আছে।
দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি: রাস্তায় আজও চলে চাঁদাবাজি, ঘুষ দিয়ে রুট পারমিট ও ফিটনেস সংগ্রহ, অনিয়ন্ত্রিত বাস চলাচল, যা সড়ক দুর্ঘটনার বড় কারণ।
সংগঠনের মধ্যে বিভাজন: অনেক সংগঠন থাকলেও তাদের মধ্যে ঐক্যহীনতা ও দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য আন্দোলনের ধারাবাহিকতা ব্যাহত করেছে।
সচেতন নাগরিক ও ছাত্রদের পক্ষ থেকে মোস্তানছিরুল হক চৌধুরী বলেন:> “যাত্রী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠন ‘বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি’ দীর্ঘদিন ধরে সড়ক দুর্ঘটনা, যাত্রী হয়রানি ও নিরাপত্তাহীনতার বিরুদ্ধে সোচ্চার। যদি নিসআ-এর মতো আন্দোলনধর্মী প্ল্যাটফর্ম এবং যাত্রী অধিকার রক্ষা নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো সম্মিলিতভাবে কাজ করে, তবে খুব শিগগিরই বাংলাদেশের পরিবহন সেক্টরের চেহারাই পাল্টে যাবে।”
মোস্তানছিরুল হক চৌধুরী আরো বলেন সড়ক যেন মৃত্যুপুরী, আর যাত্রা যেন আতঙ্কের নাম—এটা কোনো সভ্য রাষ্ট্রের চিত্র হতে পারে না। প্রতিদিন দেশের রাস্তায় শত শত দুর্ঘটনা, প্রাণহানি, আহতের হাহাকার আর পরিবারের কান্না—এসব আমাদের বিবেককে প্রতিনিয়ত নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। এই বাস্তবতা বদলানোর শপথ নিয়েই বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি দীর্ঘদিন ধরে যাত্রী অধিকার, সড়ক নিরাপত্তা ও ন্যায়ের পক্ষ থেকে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা বলি—"সড়কে প্রতিটি প্রাণ হোক নিরাপদ, প্রতিটি যাত্রা হোক নিশ্চিন্ত"।
কিন্তু এই স্লোগানকে বাস্তবতার মাটিতে নামাতে হলে দরকার ছিল কাজ, সাহস আর সংগ্রাম। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি সেই কাজটাই করে চলেছে নিরন্তর নিরাপদ সড়ক আন্দোলন (নিসআ) ও তাদের সাথে সম্মিলিত ভাবে কাজ করবে বলে মনে করছি ।
তার এই মন্তব্য নিসআ-এর ৭ বছর পূর্তিতে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এটি শুধু প্রতীকী বিবৃতি নয়, বরং একটি কার্যকর রূপরেখার আহ্বান। যেখানে সরকার, প্রশাসন, সংগঠন, ছাত্র ও নাগরিক সকলে এক প্ল্যাটফর্মে এসে কাজ করবে।
❖ সামনের করণীয়
জাতীয় পর্যায়ে ‘নিরাপদ সড়ক কাউন্সিল’ গঠন
যেখানে নিসআ, যাত্রী কল্যাণ সমিতি, সড়ক প্রকৌশলী, নাগরিক সমাজ এবং সরকার যৌথভাবে কাজ করবে।
স্থানীয় পর্যায়ে সচেতনতা ও পর্যবেক্ষণ দল গঠন
জেলা, উপজেলা ও সিটি করপোরেশন ভিত্তিক জনপদে ট্রাফিক পরিস্থিতি নিরীক্ষণ, দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ, ও সমস্যা তুলে ধরার ব্যবস্থা করা।
তথ্যভিত্তিক গবেষণা প্রকাশনা
দুর্ঘটনার সঠিক তথ্য, কারণ, দায়ীদের পরিচয় ও দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নিয়ে গবেষণা করা।
টেকসই প্রযুক্তির ব্যবহার
ডিজিটাল টিকিট, GPS ট্র্যাকিং, ট্রাফিক ক্যামেরা, স্মার্ট সিগন্যাল সিস্টেম চালু করা।
❖ শেষ কথা
নিরাপদ সড়ক আন্দোলন (নিসআ) সাত বছরে পা দিলেও তাদের পথচলা এখনো অনেক দূরের। একটি কার্যকর, ন্যায্য ও মানবিক পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
এই আন্দোলনের চেতনা, এই পথচলার শক্তি হচ্ছে আমাদের তরুণেরা—যারা একবার প্রমাণ করেছে যে রাষ্ট্রকে জবাবদিহির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো সম্ভব।
আসুন, আমরা যারা সচেতন নাগরিক, আমরা যারা ছাত্র, আমরা যারা যাত্রী,
সবাই মিলে এক কণ্ঠে বলি:
“আর নয় সড়কে মৃত্যু, চাই নিরাপদ সড়ক, মানবিক রাষ্ট্রব্যবস্থা।”
“নিসআ শুধু অতীত নয়, এটি ভবিষ্যতের প্রতিজ্ঞাও।”
লেখকঃ
সচেতন নাগরিক ও ছাত্র