
বাংলাদেশের সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরেই নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। তবে সম্প্রতি রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন বড় সড়কে অটোরিকশা ও ব্যাটারীচালিত ইজিবাইকের বিস্তৃতি সড়ক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটি বড় হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। গত কয়েক বছরে অটোরিকশা ও ইজিবাইকের সংখ্যা এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, আগে ১০ মিনিটে যাওয়া যেত এমন রাস্তা এখন ১–২ ঘণ্টারও বেশি সময় লাগে। এটি শুধু সময়ের অপচয় নয়, বরং জরুরি সেবা, স্কুল, অফিস, হাসপাতালে পৌঁছানো—সবকিছুকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধুমাত্র সেপ্টেম্বর মাসে দেশজুড়ে ৫০৪টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ৫০২ জন নিহত এবং আহত ৯৬৪ জন। এই সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে, যা স্পষ্ট করে দেয় যে দেশের সড়ক পরিবহন নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখন ক্রান্তিকালীন অবস্থায় আছে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাটারীচালিত অটোরিকশার নিবন্ধনের উদ্যোগ নিয়েছে। যদিও এর উদ্দেশ্য ভালো—নিয়ন্ত্রিত ও বৈধ পরিবহন নিশ্চিত করা—তবে প্রাথমিক পরিকল্পনায় গলদ ও পর্যাপ্ত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা না থাকলে এই পদক্ষেপ সড়ক দুর্ঘটনার হার দ্বিগুণ করতে পারে। দেশের জাতীয় মহাসড়ক, যা দীর্ঘদিন ধরে নিরাপদ ও দ্রুত চলাচলের জন্য পরিচিত, সেখানে অটোরিকশা ও ইজিবাইকের অনিয়ন্ত্রিত চলাচল এক বড় ঝুঁকি হয়ে দাঁড়াবে।
এখানেই মূল সমস্যা:
1. নিয়ন্ত্রণহীন যানবাহন: ইজিবাইক এবং অটোরিকশার সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কোনো সীমিত পারমিট বা রুট নীতি কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে না।
2. ড্রাইভারের দক্ষতা ও প্রশিক্ষণ: অধিকাংশ চালক প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ছাড়া রাস্তায় চলে। এটি দুর্ঘটনার মূল কারণগুলোর একটি।
3. পরিষ্কার আইন না থাকা: অবৈধ, অরেজিস্টার্ড যানবাহন এবং ট্রাফিক নিয়ম অমান্য করার কারণে দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
4. সড়ক অবকাঠামোর অসঙ্গতি: জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কগুলোর বেশিরভাগই ইজিবাইক ও অটোরিকশার চাপ সহ্য করতে সক্ষম নয়।
সমাধান বিকল্প রয়েছে, কিন্তু তা সরকার, সামাজিক সংগঠন এবং নাগরিকদের যৌথ উদ্যোগ ছাড়া সম্ভব নয়। প্রথমে জরুরি পদক্ষেপ হওয়া উচিত:
অটোরিকশা ও ইজিবাইকের জন্য নিয়ন্ত্রিত রুট ও সময়সূচী নির্ধারণ।
চালক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা।
যথাযথ যানবাহন নিবন্ধন ও নিরাপত্তা মানদণ্ড নিশ্চিত করা।
দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান ভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ করে সড়ক নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য বিশেষ আইন প্রণয়ন।
অন্যথায়, আমরা একটি সময়ের মধ্যেই এমন একটি পরিস্থিতির মুখোমুখি হব, যেখানে সড়ক দুর্ঘটনা এবং যানজট বাংলাদেশের প্রতিদিনের জীবনের অংশ হয়ে যাবে। দেশের নিরাপদ ও কার্যকর সড়ক পরিবহন নিশ্চিত করার জন্য এখনই পদক্ষেপ নেওয়া অত্যাবশ্যক।
নিরাপদ সড়ক চাই, যাত্রী কল্যাণ সমিতি, রোড সেইফটি ফাউন্ডেশন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ও নাগরিক সমাজের সকল সচেতন ব্যক্তি যদি একত্রিত হয়ে সরকারের সাথে কাজ করেন, তাহলে সড়ক দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব। অন্যথায়, অটোরিকশা ও ইজিবাইকের অবাধ চলাচল দেশে অব্যবস্থাপনার নতুন দিগন্ত খুলে দেবে।
লেখক: মোস্তানছিরুল হক চৌধুরী
যুগ্ন সম্পাদক, যাত্রী কল্যাণ স্টুডেন্ট কমিটি
Leave a Reply