চট্টগ্রাম—বাংলাদেশের আধ্যাত্মিক রাজধানী, যাকে বলা হয় “বারা আউলিয়ার পূর্ণভূমি”। এই পবিত্র ভূমি যেন যুগে যুগে আল্লাহর অলি ও সুফি ধর্ম প্রচারক গনের আগমনে ধন্য হয়ে উঠেছে। সমুদ্রতীরবর্তী এই প্রাচীন জনপদে ইসলাম প্রচার করেছেন অসংখ্য সুফি-সাধক, দরবেশ ও আল্লাহপ্রেমী অলি-বুজুর্গ। তাঁরা এসেছিলেন কেবল দাওয়াতের জন্য, কেবল শান্তির ধর্ম ইসলামের বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য। কোরআন ও হাদিসের আলোয় মানুষকে সত্যের পথে আহ্বান করেছেন, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষা দিয়ে দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য আলোকিত করেছেন মানবসমাজ।
তেমনি একজন মহান সাধক ছিলেন হযরত সুলতান আহমদ শাহ (রাহ:)। চট্টগ্রাম নগরীর পাঁচলাইশ থানার অন্তর্গত আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতালের পূর্বদিকে, ঐতিহাসিক ঘাট ফরহাদ বেগ এলাকায় হযরত সুলতান শাহ ( রাহ:) এর মাজার শরীফ অবস্থিত। স্থানীয় দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে, এবং প্রায় দেড় শতাব্দী আগে প্রতিষ্ঠিত চুন্ন বিবি প্রকাশ আঁতরজান জামে মসজিদের সংলগ্ন কবরস্থানেই রয়েছে এই পবিত্র মাজার। কথিত আছে, উনিশ শতকের শেষভাগে, ১৮৯৮ সালের দিকে এখানে হযরত সুলতান শাহ (রাহ:)-এর সমাধিকে কেন্দ্র করে সম্মানিত স্হান পরিনত হয়। সময়ের প্রবাহে এটি আজ চট্টগ্রামের মানুষের কাছে ভক্তি ও শ্রদ্ধার এক মহামিলনস্থলে রূপ নিয়েছে। হযরত সুলতান শাহ (রাহ:) ছিলেন এক পরহেযগার দরবেশ। তাঁর জীবন ছিল নির্লোভ, বিনয়ী এবং আল্লাহর প্রেমে পূর্ণ। স্থানীয়দের মুখে মুখে শোনা যায়, তিনি ছিলেন দানশীল ও দরিদ্রবান্ধব, যিনি সর্বদা মানুষের কষ্ট ভাগাভাগি করতেন। সমাজের দুর্বল ও বঞ্চিত মানুষ তাঁর কাছে আশ্রয় পেত, দুঃখী মন খুঁজে নিত সান্ত্বনা।সাধকরা বলেন, তাঁর দোয়ার বরকতে বহু অসহায় মানুষ কল্যাণ লাভ করেছেন। কেউ অসুখ থেকে মুক্তি পেয়েছেন, কেউ জীবনের সঙ্কট থেকে পরিত্রাণ পেয়েছেন। এ কারণেই তাঁর সমাধি/ মাজার শরীফের আঙিনায় গেলে মানুষ আজও অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব করে। মনে হয়, এক অদৃশ্য নূরের ছায়া চারপাশে বিরাজমান। প্রতিদিন ভোর থেকে রাত পর্যন্ত মানুষের আনাগোনা ও স্থানীয়রা শ্রদ্ধা ভক্তি, জিয়ারত করতে দেখা যায়। কেউ কেউ নীরবে ফাতিহা পড়ে, কেউ মোনাজাত করে চোখ ভিজিয়ে ফেলে। তবে সমাধিটি কবরের মতো সাধারন। কোন পাকা ইমারত নেই, পাশে বিশাল মসজিদ। সমাধির এক পাশে দেয়ালে একটি পাথরে খুদাই করে হযরত সোলতান শাহ ( রাহ:) চিহ্ন আছে মাত্র। পাশে অন্য মানুষের সমাধিও আছে। ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ রবিবার সকালে মরমী কবি মোহাম্মদ নাজমুল হক ভাইয়ের বাসায় আমি ( সোহেল মো. ফখরুদ-দীন) ও সুফি ওমর ফারুক চায়ের আমন্ত্রণে গমন করি। সেখান থেকে নাজমুল হক শামীম আমাদেরকে হযরত সোলতান শাহ ( রাহ:) মাজার জিয়ারত ও পরিদর্শনে নিয়ে যায়।
হযরত সুলতান শাহ (রাহ:) যেন ছিলেন ভালোবাসার সাগরের এক মুক্তা।
তাঁর নাম উচ্চারিত হলে মনে হয়—
“এক সুলতান, যিনি সিংহাসনে নন, বরং মানুষের অন্তরে রাজত্ব করেছেন।”
মাজারে দাঁড়ালে বাতাসে ভেসে আসে মরমী আবহ— " মাটির নিচে ঘুমিয়ে আছেন যিনি,
তাঁর দরজায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম খুঁজে নেয় শান্তি " ।
তাঁর নীরব কবর যেন কথা বলে—
“ভালোবাসো আল্লাহকে, ভালোবাসো মানুষকে,
তাহলেই মুক্তি মিলবে।”
এই পবিত্র স্থান শুধু ধর্মীয় ভক্তির কেন্দ্র নয়, বরং সমাজের নৈতিক দিশা এবং ঐতিহ্যের জীবন্ত প্রতীক।
চট্টগ্রামের আধ্যাত্মিক সম্পদ:- চট্টগ্রামের প্রতিটি আউলিয়ার মাজার এক একটি আলোকবর্তিকা। হযরত সুলতান শাহ (রাহ:) তাঁদেরই ধারাবাহিকতায় এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর জীবন, ত্যাগ ও আধ্যাত্মিক কেরামত আজও মানুষকে সত্য ও কল্যাণের পথে আহ্বান করে। সমাজ যখন সংকটে পড়ে, মানুষ যখন অস্থিরতায় ডুবে যায়, তখন এ ধরনের আধ্যাত্মিক আসন মানুষের হৃদয়ে জাগায় আশা ও শান্তির আলো। হযরত সুলতান শাহ (রাহ:)-এর মাজার কেবল একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন নয়, বরং এটি চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারের অংশ। এখানেই মিশে আছে মানুষের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা এবং আল্লাহর রহমতের প্রত্যাশা।
মাজারে দাঁড়িয়ে যখন বাতাসে ভেসে আসে আজান, কোরআনের সুর আর মানুষের দোয়ার শব্দ—তখন বোঝা যায়, হযরত সুলতান শাহ (রাহ:) আজও জীবন্ত তাঁর আধ্যাত্মিক প্রভাব দিয়ে যাচ্ছে । তাঁর জীবন আমাদের শেখায় বিনয়, ত্যাগ, ভালোবাসা ও সেবার শিক্ষা। তাঁর মাজার শরীফ চট্টগ্রামের মানুষকে যুগে যুগে স্মরণ করিয়ে দেয়—আল্লাহর অলিদের জীবন আসলে আল্লাহর ভালোবাসার দৃষ্টান্ত, আর তাঁদের পদচিহ্ন অনুসরণেই রয়েছে সত্য ও শান্তির পথ। হযরত সুলতান শাহ ( রাহ:) এর মাজারের অল্পদুরে হযরত বদর আউলিয়া / পীর বদরের মাজার শরীফ ও শহরকুতুব হযরত শাহ আমানত ( রাহ:) এর মাজার শরীফ।
লেখক: সভাপতি, মুসলিম হিস্ট্রি এসোসিয়েশন, পরিচালক ও সম্পাদক, ইতিহাসের পাঠশালা, চট্টগ্রাম। বাংলাদেশ।