মোঃ মনিরুল ইসলাম রিয়াদ
স্টাফ রিপোর্টার
নিত্যপণ্যের দাম এখন আগের চেয়ে কিছুটা স্বস্তি মাছ-মাংসের দরও অপরিবর্তিত। সবমিলিয়ে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের সংসারের হিসেব-নিকাশে যখন কিছুটা স্বস্তির হাওয়া, তখনই কিনা মধ্যবিত্তদের মনে জমতে শুরু করেছে ‘দুশ্চিন্তার মেঘ’। হঠাৎ করে চালের বাজারের অস্থিরতা খরচের চিন্তা বাড়িয়েছে দ্বিগুণ।
সবচেয়ে বড় কথা-চালের দাম এমন সময়েই বাড়ল, যখন কিনা বোরো মৌসুমের সোনালী সময়। সাধারণত বাংলাদেশে কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে (অক্টোবর-নভেম্বর) শুরু হয় বোরো ধান রোপণ। আর সেই ধান কাটা হয় বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ (এপ্রিল-জুন) মাসজুড়ে। সে হিসেবে এখন বোরো ধান বাজারে আসার সময় চলছে। কিন্তু ধানের সেই ভরা মৌসুমেই চট্টগ্রামে চালের বাজারে ‘আগুন
চট্টগ্রামের চালের পাইকারি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গত এক মাসের ব্যবধানে বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা বেড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারেও। বর্তমানে সব চালেই কেজিপ্রতি ৪ থেকে ৯ টাকা বাড়তি। মূলত কোরবানের ঈদের পর থেকে চালের দাম বাড়তে শুরু করেছে। এর আগে চালের দাম তুলনামূলক কম ছিল। তবে এক মাসের ব্যবধানে বেড়েছে দাম। এর মধ্যে সরু চালের দামই বেশি। চট্টগ্রামে বেশি বিক্রি হওয়া জিরাশাইল চালের দাম বেড়েছে বস্তায় ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। চট্টগ্রামে মূলত দুটি বড় আড়ত থেকেই চাল সরবরাহ হয়। এর মধ্যে মূল আড়ত পাহাড়তলী বাজার। এর বাইরে বড় আড়ত রয়েছে চাক্তাইয়ে। গত বছরের এই সময়ে চালের আড়তে মোটা চাল (গুটি, স্বর্ণা) কেজিপ্রতি ৪৮ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অন্যদিকে জিরাশাইল বিক্রি হয়েছে ৭২ টাকায়। কাছাকাছি দামে বিক্রি হয়েছে মিনিকেট আতপ। আগামী মাসের শুরুতে দাম কমতে পারে বলে আশা করছেন ব্যবসায়ীরা।
দাম বাড়ার প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে চালের দাম বাড়ার পেছনে অন্তত চারটি কারণ পাওয়া গেছে। সেই কারণগুলোর অন্যতম হলো পরিবহনের ভাড়া বেড়ে যাওয়া। এছাড়া চালকলে খরচ বেশি পড়া, করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর মজুত এবং কৃষকদের ধানের দাম বাড়ানোও দায়ী।
সাধারণত চট্টগ্রামে কিছু ধান উৎপাদিত হয় বটে। তবে তা চাহিদার তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। এখানে বেশিরভাগ চালই আসে উত্তরাঞ্চল ও এর আশপাশের জেলা থেকে। চাল ব্যবসায়ীরা জানান, সাধারণত পিকআপ ভ্যান ও ট্রাকে করে চাল ও ধান নিয়ে আসা হয় বন্দরনগরীতে। তবে কোরবানের ঈদকে কেন্দ্র করে বেশিরভাগ পিকআপ ভ্যান ও ট্রাক প্রাণী এবং চামড়া পরিবহনে যুক্ত ছিল। আবার এখন চলছে ফলের মৌসুম। এ কারণে গাড়িগুলো ফল বাজারকেন্দ্রীকও বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। গাড়ি সংকটে চাল পরিবহনে খরচ বেড়ে গেছে।
চট্টগ্রামে রাইস মিল মালিক সমিতির আওতায় প্রায় ১২৬টি চালকল রয়েছে। চালকলগুলো দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ধান সংগ্রহ করে চাল তৈরি করে। তারা বলছে, ধানের জোগান থাকলেও খরচ পড়ছে বাড়তি।
এছাড়া করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো চাষিদের অগ্রিম টাকা দিয়ে চাল কিনে নিচ্ছে। এ কারণে মিলের মালিকেরা ধান পাচ্ছেন কম। এটাও দাম বাড়ার পেছনে কারণ। গত বছরে এ সময়ে কৃষকেরা প্রতি মণ ধানের দাম রেখেছিলেন ১ হাজার ১৫০ থেকে ১ হাজার ৩৫০ টাকা পর্যন্ত। বর্তমানে প্রতি মণ ধানের দাম ১ হাজার ২৫০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা পর্যন্ত পৌঁছেছে।
চট্টগ্রাম রাইস মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রফিক উল্লাহ বলেন, এই বছর গত বছরের তুলনায় আবহাওয়া ভালো ছিল। বৃষ্টিপাত কম হয়েছে। সেজন্য কৃষকেরা ধান কাটার পর নিজেদের গোলায় জমিয়েছে। দেখা যাচ্ছে বৃষ্টি হলে তারা কিছু ধান বিক্রি করেন, আবার বৃষ্টি কমলে দাম বাড়ানোর জন্য জমা করে রাখেন। তাদের এই কৌশলের কারণে এবার ধানের দাম কিছুটা বেড়েছে। সেটির প্রভাব পড়েছে চালের বাজারে। এছাড়া বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো আগেভাগে ধান সংগ্রহ করে ফেলেছে। এখন তারা চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন। এসব কারণে চালের দাম বেড়েছে।
পরিবহন খরচ প্রায় দেড়গুণ বেশি ভাড়াসহ চার কারণে চালের দাম বেড়েছে বলে জানিয়েছেন পাহাড়তলী বণিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এস এম নিজাম উদ্দিন। তিনি বলেন, এখন ধানের ভরা মৌসুম। প্রতি বছর এই সময়ে স্বাভাবিকভাবে ধানের দাম কম থাকে। কিন্তু এবার হয়েছে উল্টো। নানাকারণে পরিবহন ব্যয় বেড়ে গেছে। আগে যে গাড়ির ভাড়া ২০ হাজার ছিল সেটি ৩৫ হাজার পর্যন্ত পৌঁছেছিল। আর যেটির ভাড়া ছিল ২৫ হাজার, সেটি হয়ে যায় ৪২ হাজার পর্যন্ত। অবশ্য এখন কিছুটা কমেছে। আর বৃষ্টি কম হওয়ায় নৌকা চলতে না পারায় এবার হাওর অঞ্চল থেকে সেভাবে ধান বের হতে পারেনি, ওটাও কারণ। এছাড়া কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণ তো আছেই।
তবে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, দেশে ধান-চালের পর্যাপ্ত মজুত আছে। একেবারেই সংকট নেই। এরই মধ্যে আগের তুলনায় চালের দাম কিছুটা কমতে শুরু করেছে। মূল সংকট তদারকি কার্যক্রমে। উত্তরবঙ্গসহ যেখানে পর্যাপ্ত ধান উৎপাদন হয় সেদিকে সরকার নজরদারি বাড়ালে ধানের দাম আরও কমে আসবে। আর ধানের দাম কমা মানেই তো চালের বাজারে সত্যি নিঃশ্বাস, মধ্যবিত্তদের মুখে হাসি।
Leave a Reply