1. news@dainikchattogramerkhabor.com : Admin Admin : Admin Admin
  2. info@dainikchattogramerkhabor.com : admin :
শুক্রবার, ৩০ মে ২০২৫, ১২:৪০ পূর্বাহ্ন
শিরোনামঃ
বৈষম্যবিরোধীদের মিছিল থেকে জি এম কাদেরের বাড়ি ভাঙচুর, মোটরসাইকেলে আগুন মইজ্জার টেক হাটে মরুর অতিথি উট কালিগঞ্জ উপজেলায় পৌরসভা গঠনে প্রস্তুতি সভা অনুষ্ঠিত বাঁশখালী গুনাগরী পল্লীবিদ্যুৎ অফিসের কর্মকর্তারা অফিসে বসে বিল বানিয়ে পকেট কাটছেন গ্রাহকদের। বোয়ালখালীতে জাতীয় পুষ্টি সপ্তাহের উদ্বোধন এপেক্স ক্লাব অব বান্দরবান, সাংঙ্গু ও নীলাচলের পালাবদল ও ক্লাব স্কুলিং অনুষ্ঠিত। জুমার দিনে আগেভাগে মসজিদে আসার ফজিলত: শায়ের মুহাম্মদ আকতার উদদীন লামায় “তারুণ্যের অগ্রযাত্রায় আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণে গণমাধ্যমের ভূমিকা” শীর্ষক মতবিনিময় সভা  অনুষ্ঠিত পুলিশে সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) নিরস্ত্র পদে ৮ হাজার নতুন জনবল নিয়োগের প্রস্তাব নগরীর চান্দগাঁওয়ে ছিনতাইকারীসহ তিন আসামি গ্রেপ্তার

মনসার টেক স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম কমিটি -নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

  • সময় বুধবার, ২৮ মে, ২০২৫
  • ৪৬ পঠিত

আগে বলা হয়েছে………..
পটিয়া থানার হুলাইন গ্রাম নিবাসী আবুল হাশেম মাস্টার ছিলেন হাবিলাসদ্বীপ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। তিনি রাজনীতি সচেতন ছিলেন এবং বঙ্গবন্ধু ৬ দফার দেয়ার পর থেকে রাজনীতিতে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার সঞ্চার হলে হাশেম মাস্টার তাতে উদ্বাদ্ধ হন এবং আওয়ামী লীগ যোগদান করেন। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে তিনি হাবিলাসদ্বীপ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। এই সময় থেকে তিনি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের মুখ ব্যক্তি হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৭১ এর জানুয়ারির উত্তাল দিনগুলোতে ছাত্রলীগের কতিপয় কর্মীর স্বেচ্ছাচারিতা ও অবাধ্যতায় বিরক্ত হয়ে এবং কমরেড চৌধুরী হারুনুর রশীদ এবং কমরেড এডভোকেট নুরুন্নবী চৌধুরীর আলাপ-আলোচনায় সন্তুষ্ট হয়ে হাশেম মাস্টার তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাÐের কেন্দ্র পাঁচরিয়া দীঘির পাড় থেকে মনসার টেকে স্থানান্তরিত করেন। কারণ মনসার টেকেই তিনি কাজ করতে অস্বস্তিবোধ করছিলেন।
’৭১ এর ১ মার্চের জাতীয় সংসদের অধিবেশন ইয়াহিয়া খান কর্তৃক স্থগিত ঘোষণা করার পর সারাদেশের ন্যায় হুলাইন, মনসা, পাঁচরিয়া, হাবিলাসদ্বীপ গ্রামের মানুষও বিক্ষোভে অনেকটা সক্রিয় হয়ে উঠে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কর্তৃক ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের পরপরই রাত্রে বৈঠক করে হুলাইন, মনসা, পাঁচরিয়া, এয়াকুবদÐী, মেহেরআটি ইত্যাদি গ্রামের লোক নিয়ে ৫১ সদস্য বিশিষ্ট ‘‘মনসার টেক স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম কমিটি’’ গঠন করা হয়। এই কমিটির সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয় কমরেড অ্যাডভোকেট নুরুন্নবী চৌধুরীকে এবং তাঁর অসম্মতি সত্তে¡ও আবুল হাশেম মাস্টারকে সেক্রেটারির দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই কমিটির মাধ্যমে মনসার টেকে চেকপোস্ট স্থাপন করা হয়। আবুল হাশেম মাস্টারকে তখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাত-দিন মনসার টেকেই কাটাতে হয়েছে। অ্যাডভোকেট কমরেড নুরুন্নবী চৌধুরীর আদেশ, নির্দেশ ও পরামর্শ দিয়ে তাঁকে সক্রিয় সহযোগিতা করেছেন। তার মতো একজন বিজ্ঞ ও সক্রিয় রাজনৈতিক নেতাকে পেয়ে সেক্রেটারির গুরুদায়িত্ব পালন তাঁর জন্যে অনেকটা সহজ হয়েছিল। যেন কোন সুযোগ সন্ধানী তাদের দলে ঢুকে তাঁদের ইমেজ নষ্ট করতে না পারে সে ব্যাপারে তিনি খুবই সতর্ক ছিলেন। আর একারণে তিনি এবং এডভোকেট নুরুন্নবী অনেকের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। হাশেম মাস্টার তাঁর সামান্য আয়ের সবটুকুই এ কমিটির কর্মকাÐে ব্যয় করেছেন, স্বার্থ তাঁকে কখনো নীতিচ্যুত করতে পারেননি।
গ্রামের কিছু ছেলে মুক্তিযুদ্ধ করার জন্য ভারতে গিয়ে ট্রেনিং গ্রহণ করে অস্ত্র নিয়ে এলাকায় এসে যুদ্ধ করার পরিবর্তে চুরি ডাকাতি আরম্ভ করে। হাশেম মাস্টার এতে বাধা প্রদান করলে তাঁর সঙ্গে কথিত মুক্তিযোদ্ধাদের সংঘাত বাধে। এক পর্যায়ে তারা হাশেম মাস্টারকে হত্যা করার জন্য হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে। তারা একাধিক দফায় তার বাড়ি এবং সম্ভাব্য আশ্রয়স্থল ঘেরাও করে তল্লাশি চালায়।
এরপর পড়–ন………
এ অবস্থায় হুলাইনে নিজের বাড়ি অথবা এয়াকুবদÐী কিংবা মনসা গ্রামেও থাকতে গেলে এলাকার মুক্তিযোদ্ধা নামধারী ডাকাতরা তাঁকে হত্যার জন্য হামলা করতে পারে এই আশংকা করে আবুল হাশেম মাস্টার শহরে গিয়ে আত্মগোপন করেন এবং স্বগ্রাম নিবাসী আহমদ হোসেন খান, মো. ইছহাক মাস্টার (পেস্কার)সহ এডভোকেট জালাল উদ্দীন আহমদ চৌধুরীর ফিরিঙ্গিবাজারস্থ বাসায় গিয়ে তাঁকে বিস্তারিত জ্ঞাত করে তাঁর নিরাপত্তা সম্পর্কে মতামত চান। তাদের তিনজনের পরামর্শ মতে জুলাই মাসের শেষ পর্যায়ে কুমিল্লা গিয়ে বি-এড কলেজে ভর্তি হয়ে সপ্তাহখানেক ক্লাশ করার পর তাঁর উপস্থিতি চালিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব ২/৩ জন কর্মচারি ও হোস্টেল সেক্রেটারির উপর প্রদান করে আগস্ট মাসের মাঝামাঝি বাড়িতে চলে আসেন। উল্লেখ্য যে, ইতিমধ্যে তিনি বিদ্যালয় হতে ডেপুটেশনে ছুটি নিয়ে কুমিল্লা বি-এড কলেজে ভর্তি হওয়ার খবরটি এলাকায় বিস্তারিতভাবে প্রচারিত হয়। কিন্তু কুমিল্লা থেকে চলে আসার পর চট্টগ্রাম শহরে ও বাড়িতে তাঁকে দেখে তারা পুনরায় রাতে কয়েক দফা তাঁর বাড়ি ঘেরাও করে তাঁকে ধরার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠে। কিন্তু কুমিল্লা থেকে ফিরে এসে তিনি কোন সময়ই রাতে তাঁর বাড়িতে অবস্থান করেননি বিধায় তারা তাঁকে ধরতে পারেনি।
পর পর কয়েক রাতে বাড়ি ঘেরাও করার খবর জ্ঞাত হয়ে তিনি ক্যাপ্টেন করিম ও সার্জেন্ট আলমের সাথে দেখা করার জন্যে চেষ্টা করেন। কয়েকদিনের মধ্যে চরকানাই গ্রামের তাঁর এক ছাত্রের নিকট জানতে পারেন যে, দলীয় লোকেরা শত্রæতা করে সার্জেন্ট আলমকে খুন করেছে। খবরটা শুনে খুবই মর্মাহত হলেন। ইতিমধ্যে পাঁচরিয়ায় একদিন মাহফুজুর রহমান খানের পিতার সাথে তাঁর সাক্ষাত হয়। সাক্ষাতে তিনি কেঁদে কেঁদে বললেন যে, মাহফুজের কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। লোকে বলাবলি করছে যে, ভারতে চলে যাওয়ার সময় পাকবাহিনী তাকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। তিনি উনাকে সান্ত¡না দিয়ে বলেন যে, ‘আপনি চিন্তা করবেন না, তিনি এক সপ্তাহের মধ্যে আপনাকে সঠিক খবর জানিয়ে দেব’।
মনসা গ্রামের রিকসাওয়ালা মোনাফকে নিয়ে তিনি পটিয়া হয়ে কানুনগোপাড়া কলেজের সামনের রাস্তা ধরে নদীর পাড়ে এক বাড়িতে রিকসাটা জিম্মায় রেখে সাম্পানে নদীর উত্তর পাড়ে গিয়ে বিভিন্ন গ্রামে ক্যাপ্টেন করিমের খোঁজ নিতে থাকেন। এভাবে ২ দিন ১ রাত খোঁজ করে পরবর্তী রাত ১০টায় পাহাড়তলীর নিকটে মহামুনী বড়–য়া পাড়ায় এক বাড়ির দ্বিতলে ক্যাপ্টেন করিমের একটি ক্যাম্পের সন্ধান পান। সে ক্যাম্পে মনসা গ্রামের আবুল কাশেম ও স্বগ্রাম নিবাসী মাহফুজুর রহমান খানের সাথে সাক্ষাত হয়। মাহফুজকে তার পিতার কথা বলে অনেক বকাবকি করেন। সে তাঁকে তার পিতাকে দেয়ার জন্যে একটি চিঠি লিখে দেয়। সে ক্যাম্পে ক্যাপ্টেন করিমকে না পেয়ে রাত ১২টায় তাদের সাথে ভাত খেয়ে রাতেই তারা ৬/৭ জনের একটি দল লাম্বুরহাট যাত্রা করে প্রায় ৩টার দিকে একটি দোকানে করিম ও তার অপর দলের মিলিত হন। ক্যাপ্টেন করিমের নিকট তাঁর অসহায়ত্বের কথা সবিস্তারে বর্ণনা করাতে তিনি সপ্তাহ খানেক পরে তাঁর এলাকায় আসার একটি প্রোগ্রাম করেন এবং সকলের প্রস্তুতি নেওয়ার ও নির্দিষ্ট একটি স্থানে অপেক্ষা করার জন্যে পরামর্শ দেন। তাদের নিকট থেকে বিদায় নিয়ে নদীর দক্ষিণ তীরে এসে রেখে যাওয়া রিকসাটি নিয়ে গোমদÐী হয়ে পাঁচরিয়া আসার সাথে সাথে খবর পেলেন যে, পর পর দু’রাতে তাঁর বাড়ি ঘেরাও করা হয়েছে এবং দু’দিন ধরে দিনের বেলায় ছালেহ-নূর কলেজের দোতলায় উঠার সিঁড়ির নীচে আড্ডা দিয়ে তাঁর খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। সংবাদদাতার অনুরোধে তিনি বাড়ি না গিয়ে রিকসাওয়ালা মোনাফকে বিদায় দিয়ে বাস উঠে শহরে গমন করেন। কোর্ট বিল্ডিংয়ে গিয়ে এডভোকেট জালাল সাহেবের সাথে দেখা করেন। তিনি বাড়িতে চলে আসার পথে কথা বলতে বলতে তারা বকসিরহাট মেথর পট্টির নিকট এসে একটি বন্ধ দোকানের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ক্যাপ্টেন করিম কর্তৃক প্রদত্ত সময় ও কর্মসূচি সম্পর্কে অবগত হলেন। তাকে অনুরোধ করেন যে, যদি বাড়িতে যাওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব না হয়, তবে তিনি যেন করিমের সাথে দেখা করে কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহযোগিতা করেন। তারপর মাহফুজুর রহমান খানের পত্রটি তার পিতাকে দেওয়ার জন্যে প্রদান করে তিনি জালাল সাহেব থেকে বিদায় নিয়ে তিনি মার্কেট গিয়ে জানতে পারেন যে, নূর মোহাম্মদ চৌধুরীর স্ত্রীর ডেলিভারী কেইসের জন্যে তিনি স্ত্রীকে নিয়ে মেডিকেল কলেজে আছেন বিধায় অফিসে আসেন নাই।
উল্লেখ্য যে, রাজাকার বাহিনী কর্তৃক ইতিমধ্যে তাদের অনুসরণ করে ক্যাম্পে খবর দেয়া হয়েছিল। চাঁন মিঞা গলি থেকে জালাল সাহেবকে বন্দি করা হয়। ভাগ্যক্রমে তিনি তাদের নজর এড়িয়ে চলে যেতে সক্ষম হন। এ সংবাদটি সন্ধ্যায় আহমদ হোসেন খান সাহেবের বাসায় গিয়ে জানতে পারেন। জালাল সাহেবকে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচেষ্টা চালিয়ে রাত ১২টার দিকে মুক্ত করে আনা হয়। ভোরে ইছহাক মাস্টার, খান সাহেব ও তিনি জালাল সাহেবের বাসায় গিয়ে দেখা করেন। তিনি তাঁকে কুমিল্লা চলে যাওয়ার জন্যে চাপ সৃষ্টি করায় তিনি সেখান থেকেই বের হয়ে খান সাহেবের বাসা থেকে ব্যাগ নিয়ে কুমিল্লা চলে যান। প্রায় ১৫/২০ দিন ক্লাশ করে তিনি পুনরায় চট্টগ্রাম চলে আসেন। জানতে পারলাম যে, ক্যাপ্টেন করিম যথাসময়ে এসে মুক্তিযোদ্ধা নামধারী ডাকাতদের ধাওয়া করেছেন। তিনি বিভিন্ন স্থানে খোঁজ করেও আর তাদের সাক্ষাত পাননি।
তাঁর প্রতিবেশি সুবেদার সুলেমান সাহেব স্থানীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের কর্মকাÐে অংশগ্রহণ করেছেন জেনে খুবই খুশি হন। তার সাথে দেখা করে তিনি তাঁর ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করেন। তিনি তাঁকে বললেন যে, ক্যাপ্টেন করিমের নিকট তিনি সবকিছু জেনেছেন। তিনি তার সাথে ৩/৪ দিন কাটিয়েছেন। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। সুবেদার সুলেমানের সংস্পর্শে থাকায় এবার কেউ তাঁর বিরুদ্ধে তৎপরতা চালানোর সাহস করেননি। সুলেমান সুবেদার তাঁকে কয়েকদিন বিশ্রাম নিতে বললেন। তিনি তাঁর হেফাজতে ২টি গ্রেনেড রেখেছিলেন। তদুপরি, হাবিলাসদ্বীপ গ্রামের দেবেন্দ্র নাথ মহাজনের নিকট তাদের কমিটির শেয়ারে ক্রয়কৃত একটি রাইফেল ছিলো। দু’দিন পরে সুবেদার সাহেব তাঁর নিকট স্বগ্রাম নিবাসী আবু তাহেরের দ্বারা খবর পাঠালেন যেন, গ্রেনেড ও রাইফেলসহ তিনি খুব সতর্ক অবস্থায় আবু তাহেরের সাথে শাকপুরা বড়–য়ার টেকের দিকে যান। আবু তাহের সহ তিনি হাবিলাসদ্বীপ গিয়ে দেবেন্দ্র মহাজনকে না পেয়ে চরকানাই ফুলতলীর দিকে অগ্রসর হন। কাছাকাছি গিয়ে দেখেন যে, কিছুসংখ্যক রাজাকার ও পাকিস্তানি অস্ত্র তাক করে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তাদের পিছনে পিছনে ২টি ট্রাক ও ১টি জিপ। তারা ভয় পেয়ে ভক্তি পাড়ার ভিতের দিয়ে ফিরে আসার সময় আবু তাহের সুবেদার সুলেমানকে ধানক্ষেতের ভিতর ক্রলিং করে অগ্রসর হতে দেখলে তারা দৌড়ে তার নিকট গিয়ে বড়–য়ার টেকে রাজাকারদের সাথে আক্রমণের কথা জানতে পারে। রাজাকারদের সাথে পাকবাহিনী এসে যোগ দেয়ার সাথে সাথে তার সাথীরা কখন যে তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পালিয়ে গেছে তা তিনি জানেন না বলে জানান। ধান ক্ষেতে ও খেয়াঝাড়ে ক্রলিং করার সময় তার দেহ ক্ষতবিক্ষত। তার নিকট যা গুলি ছিল সবই শেষ। তিনি খুবই ক্লান্ত। তারা তাকে নিয়ে অনেক কষ্টে ছালেহ নূর কলেজের নিকট এসে পেঁৗঁছলে তিনি তাদের সেখানে অপেক্ষা করে রাজাকার ও পাকবাহিনীর গতিবিধির প্রতি লক্ষ্য রাখার কথা বলে নিজ বাড়িতে চলে যান। দিনটি ছিল শুক্রবার। প্রায় ঘণ্টা খানেক অপেক্ষা করার পর পাকবাহিনী এদিকে অগ্রসর না হওয়ায় জুমার নামাজের জন্যে চলে এসে সুলেমান সাহেবকে ঘর থেকে বের না হতে বলে গোসল করতে মসজিদে চলে যান।
পরের দিন কুমিল্লা থেকে একটি পত্র পেলেন। নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে তাদের প্রথম সাময়িক পরীক্ষা। তিনি কুমিল্লা চলে গিয়ে যথারীতি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। পরীক্ষা শেষে জানতে পারেন যে, তাদের ১২ জনের ১ টি তালিকা প্রস্তুত করে প্রিন্সিপালকে দেয়া হয়েছে যেন তা ক্যান্টনমেন্টে পাঠিয়ে দেয়া হয়। দায়িত্বে ছিলেন ভাইস প্রিন্সিপাল। তিনি তালিকা প্রস্তুতকারীদের সাথে বৈঠক করে আলোচনার মাধ্যমে তাদের বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হন যে, এ তালিকা ক্যান্টনমেন্টে পাঠানো হলে এবং ১২ জনকে ধরে নেয়া হলে কলেজে কারো নিরাপত্তা থাকবে না। মুক্তিবাহিনী খবরটি জানতে পারলে বি-এড কলেজ উড়িয়ে দেবে। ফলে কারো বাঁচার উপায় থাকবে না। এভাবে তালিকাটি ক্যান্টনমেন্টে পাঠানো থেকে বিরত রাখা হয়েছিল। ভাইস প্রিন্সিপাল জনাব নাজমুল হক তাদের সতর্ক থাকতে বললেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে এখনো তার নিকট কৃতজ্ঞ।
ডিসেম্বর মাসের ৩ তারিখে ভারত পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করল। ভারতীয় বিমান আক্রমণে কুমিল্লা শহর প্রকম্পিত। বি-এড কলেজের পাশেই ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট। সেখানে থাকা আর নিরাপদ মনে করলেন না। রাউজান নিবাসী একজন রুমমেটসহ ৬ তারিখ বিকেল বেলা কুমিল্লা শহরে এসে রাজগঞ্জ বাজারের নিকট পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর ছৈয়দ আহমদের বাসায় গেলেন। তিনি ছিলেন সুচক্রদÐী নিবাসী বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের ডেপুটি সচিব শামসুল আলমের ভগ্নিপতি। তিনি কানুনগোপাড়া কলেজে পড়ার সময় ছৈয়দ আহমদ সাহেবের আহলা সাদার পাড়ার বাড়িতে দু’বছর লজিং ছিলেন। বি-এড কলেজে থেকে যাওয়ার কারণে তিনি ও তার স্ত্রী তাঁকে অনেক বকাঝকা করেছেন এবং বলেন যে, অতিসত্বর যেন তিনি বি-এড কলেজ থেকে চলে ওখানে উঠেন।
পরের দিন খুব ভোরে বি-এড কলেজ থেকে কুমিল্লা শহরে ছৈয়দ আহমদ সাহেবের বাসায় উঠলেন। চা-নাস্তা করে বের হয়ে জানতে পারেন যে, রাতে ভীষণ যুদ্ধ হয়েছে। কুমিল্লা শহর মুক্ত, সকাল ১০টা থেকে শুরু হল মিছিল ও জয়বাংলা ধ্বনি। কুমিল্লা এয়ারপোর্টে গিয়ে তাঁর এক ক্লাসমেট কুমিল্লা জেলা স্কুলের শিক্ষকের সাথে সাক্ষাত হয়। তিনি মাইকিং করছেন রিকসায় করে, সাথে কয়েক কার্টুন স্টার সিগারেট। তাঁকে রিকসায় উঠিয়ে এয়ারপোর্টে গিয়ে ভারতীয় বাহিনীর অনুমতি নিয়ে এয়ারপোর্টে প্রবেশ করেন। এয়ারপোর্টের গেটে দেখেন ১২ জন ভারতীয় সৈন্য ও ৪ জন মুক্তিযোদ্ধার লাশ পৃথকভাবে সারিবদ্ধভাবে চাদর দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। তাদেরকে দর্শনার্থীরা ফুল দিয়ে সমবেদনা প্রকাশ করছে। আরো দেখেন যে, এদিক ওদিক পাকবাহিনীর সামরিক ট্রাক ও জীপ জ্বলছে এবং পাক সৈনিকের লাশ চতুর্দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে। এয়ারপোর্টের ভিতরে ঢুকে দেখলেন যে, রানওয়ের মাঝে মাঝে পুকুরের মত বিরাট বিরাট গর্ত এবং পাক সৈনিকের লাশ এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ভারতীয় সৈনিকদের বন্ধু সম্বোধন করে আলিঙ্গন করতঃ তাদের পক্ষ থেকে এক প্যাকেট করে স্টার সিগারেট প্রদান করেন। তারা তাদের সাথে রক্ষিত চারমিনার দিয়ে এবং শুকনো বিস্কুট দিয়ে সাথে একাত্মতা ঘোষণা করল।
রাস্তাঘাট নষ্ট হওয়ায় এবং যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় প্রায় ১৫/২০ দিন তাঁকে রাজগঞ্জে থাকতে হয়েছে। ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে কিছু পথ বাসে, কিছু পথ ট্রাকে, কিছু পথ রিক্সায় ও কিছু পথ হেঁটে বাড়ি এসে পেঁৗঁছলেন। দেখেন লুণ্ঠনকারী মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্বে বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্প পরিচালিত হচ্ছে। খুবই হতাশ হলেন এবং আরো হতাশ হলেন লুটেরা, সুবিধাবাদীরা মুজিব কোট গায়ে দিয়ে আওয়ামী লীগার ও মুক্তিযোদ্ধা সেজে দাপট চালিয়ে নিরীহ জনগণের মাঝে ভীতির সৃষ্টি করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে চলেছে।

লেখকঃ সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা

খবরটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
কপিরাইট © ২০২০ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
ওয়েবসাইট ডিজাইন: ইয়োলো হোস্ট