আমাদের বাংলা সাহিত্য অঙ্গনে আশির দশক থেকে নিরলস কলম চালিয়ে যাচ্ছেন কবি, গবেষক ও বহুমাত্রিক সাহিত্যিক মোশাররফ হোসেন খান। কবিতা, ছড়া, গল্প, উপন্যাস, শিশু-কিশোর সাহিত্য, জীবনী ও গবেষণাধর্মী রচনার বিস্তৃত ভুবনে তাঁর পদচারণা তাঁকে সমসাময়িক সাহিত্যের অন্যতম কৃতিমান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
১৯৫৭ সালের ২৪ আগস্ট যশোর জেলার ঝিকরগাছা উপজেলার বাঁকড়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ডা. এম এ ওয়াজেদ খান এবং মাতা বেগম কুলসুম ওয়াজেদ তাঁকে মানুষ করেছিলেন সৎ আদর্শ, নৈতিকতা ও শিক্ষার দৃঢ় ভিতের উপর দাঁড় করিয়ে। এই পটভূমিই তাঁকে সাহিত্যচর্চার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।
১৯৮৬ সালে প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ হৃদয় দিয়ে আগুন তাঁকে কবিতা জগতে সাহসী আত্মপ্রকাশের সুযোগ এনে দেয়। পরবর্তী সময়ে নেচে ওঠা সমুদ্র, আরাধ্য অরণ্যে, বিরল বাতাসের টানে তাঁকে ঝড়ের মাঝেও দৃঢ় মাঝির মতো প্রতিভাত করে। তবে ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত পাথরে পারদ জ্বলে গ্রন্থই তাঁকে সমসাময়িক বাংলা কাব্যভুবনে প্রবল আলোচনায় নিয়ে আসে।
ক্রীতদাসের চোখ, নতুনের কবিতা, বৃষ্টি ছুঁয়েছে মনের মৃত্তিকা, দাহন বেলায়, কবিতাসমগ্র ও কবিতাসমগ্র-২, সবুজ পৃথিবীর কম্পন, পিতার পাঠশালা, স্বপ্নের সানুদেশ ইত্যাদি গ্রন্থে কবি হিসেবে তিনি আরও গভীরতা ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। মানবিক অনুভূতি, সামাজিক চেতনা ও জীবনবোধ তাঁর কবিতাকে সমৃদ্ধ করেছে।
গদ্য সাহিত্যে তিনি সমান দক্ষ। বিশেষত সাহসী মানুষের গল্প তাঁকে নতুন খ্যাতির দুয়ারে পৌঁছে দেয়। এছাড়া রহস্যের চাদর, অবাক সেনাপতি, দূর সাগরের ডাক, কিশোর কমান্ডার, ছড়ির তরবারি প্রভৃতি গ্রন্থে তাঁর বর্ণনাশৈলী পাঠককে মুগ্ধ করেছে।
শিশু-কিশোর সাহিত্যে তাঁর অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। জীবন জাগার গল্প, সুবাসিত শীতল হাওয়া, আগুন নদীতে সাঁতার, অবাক করা আলোর পরশ, ছোটদের বিশ্বনবী সহ নানা জীবনীগ্রন্থ ছোটদের কাছে সহজ ভাষায় মহৎ অনুপ্রেরণার দিশা দেখিয়েছে। এর মাধ্যমে তিনি শিশু-কিশোরদের মানসজগতে সাহসী স্বপ্ন বোনার শিক্ষা দিয়েছেন।
গল্পগ্রন্থ প্রচ্ছন্ন মানবী, সময় ও সাম্পান, ডুবসাঁতার এবং কিশোর উপন্যাস বিপ্লবের ঘোড়া, সাগর ভাঙার দিন, ঝিমায় যখন ঝিকরগাছা, স্বপ্নের ঠিকানা ও বাঁকড়া বিলের বালিহাঁস তাঁকে কথাসাহিত্যে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে।
বাংলা সাহিত্যকে তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পৌঁছে দিয়েছেন। তাঁর কবিতা ও গল্প ইংরেজি, আরবি, উর্দু, ফারসি, হিন্দি, গুজরাটি, অহমিয়া ও রুশ ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ফলে বাংলাদেশের সাহিত্যিক ঐতিহ্য বিশ্ব দরবারে সম্মানের সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে। তিনি উপমহাদেশের খ্যাতিমান রাজনৈতিক, বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের কারাবরন কারী নেতা, সাংবাদিক, বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য,চট্টগ্রামের গৌরব মাওলানা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর জীবন ও কর্মের উপর গ্রন্থ রচনা করেছেন।
পুরস্কার ও স্বীকৃতি: বাংলা সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি অর্জন করেছেন গোলাম মোহাম্মদ সম্মাননা (২০১৯), সিএনসি ফররুখ পুরস্কার (২০১৬) এবং পরিচয় সাহিত্য পদকসহ একাধিক সম্মাননা।
কবি’ র স্ত্রী বেবী মোশাররফ, পুত্র নাহিদ জিবরান ও কন্যা নাওশিন মুশতারী ও নাওরিন মুশতারীকে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ঢাকায় বসবাস করছেন। মোশাররফ হোসেন খান কেবল কবি বা গল্পকার নন, তিনি গবেষক, শিশু-কিশোর সাহিত্যের পথিকৃৎ এবং এক নিরলস সাহিত্যকর্মী। তাঁর সাহিত্যকীর্তি বাংলা সাহিত্যের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। বহুমাত্রিক সৃজনশীলতার দীপ্ত আলোয় তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এক নতুন উচ্চতায়। আমি লেখক গবেষক মোশাররফ হোসেন খানের সুস্থ ও নিরাপদ জীবন কামনা করছি।
লেখক- পরিচালক ও সম্পাদক, ইতিহাসের পাঠশালা, সভাপতি, চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্র ( সিএইচআরসি), বাংলাদেশ।
Leave a Reply