মুসলিম বিশ্বে চট্টগ্রামের গৌরবতুল্য মহামনীষী দার্শনিক আল্লামা কাজী নুরুল ইসলাম হাশেমী ( রাহ:)। (জন্ম: ২৮ ডিসেম্বর ১৯২৮ – মৃত্যু: ২ জুন ২০২০)। ইমামে আহলে সুন্নাত নামে সমাদিক পরিচিত। ইমামে আহলে সুন্নাত, ওস্তাজুল ওলামা, শায়খুল আরব ওয়াল আজম আল্লামা কাজী মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম হাশেমী (রাহ.) ছিলেন একজন বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী মহান ইসলামি ব্যক্তিত্ব। তিনি শুধু একজন ধর্মীয় নেতা ও আলেমই ছিলেন না, বরং ছিলেন এক যুগান্তকারী চিন্তাবিদ, দরদী মুরব্বি এবং একজন অসাধারণ লেখক, যাঁর লেখনী আজও পাঠকদের চিন্তার জগতে আলো ছড়ায়।
আল্লামা হাশেমী (রাহ.)-এর লেখক পরিচয় তাঁর আলেমি পরিচয়ের মতোই বিস্তৃত ও গভীর। তিনি ইসলামের মৌলিক বিষয়সমূহকে সহজ, প্রাঞ্জল ও মননশীল ভাষায় উপস্থাপন করেছেন। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলো বাংলা ভাষাভাষী মুসলমানদের জন্য দ্বীনি শিক্ষা ও আত্মশুদ্ধির গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। তাঁর লেখনীর মূল লক্ষ্য ছিল সাধারণ মুসলমানদের অন্তর জাগানো, ভুল আকীদা থেকে রক্ষা করা এবং প্রকৃত আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের পথ টিক রাখা । দুনিয়া ও আখিরাতের শুদ্ধ পথের সন্ধানদাতা হিসেবে তিনি মহান ও স্মরণীয়। ।
উপমহাদেশে অলি-আল্লাহ ও পীর-বুজুর্গদের জীবনী গ্রন্থাকারে প্রকাশে তাঁর ভূমিকা প্রশংসনীয়। বাংলাদেশে ঈমাম শেরে বাংলা আল্লামা হযরত সৈয়দ আজিজুল হক আল কাদেরী (রাহ.) “দিওয়ানে আজিজ” কিতাবের মাধ্যমে যেভাবে অলী-বুজুর্গদের জীবনী ও অলিয়ে কেরামগনের জীবনী তুলে ধরেছেন, তেমনি পরবর্তীতে আল্লামা কাজী নুরুল ইসলাম হাশেমী (রাহ.) ‘তাজকেরাতুল কেরাম’ ১ম, ২য় ও ৩য় খণ্ডের লেখনীর মাধ্যমে অসাধারণ ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদন করেন।
তাঁর রচনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি কঠিন তাত্ত্বিক বিষয়সমূহকে সহজবোধ্য ভাষায় ব্যাখ্যা করতেন। যেমন, ‘আকাঈদ-ই বাতিল’ গ্রন্থে তিনি বাতিল ফেরকার মূলোৎপাটন করে সুন্নি আকীদার পরিস্কার দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। অপরদিকে, ‘নসিহাতুত তালিবিন’ ও ‘যাদুল মুসলিমিন’ গ্রন্থে তিনি আত্মগঠন, ইলম চর্চা এবং আমলের গুরুত্ব অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় তুলে ধরেছেন।
তাঁর রচিত ‘সত্যের আহ্বান’, ‘মুসলমানদের সম্বল’, ‘পরহেজগারদের দিশারী’ ইত্যাদি গ্রন্থ পাঠকের হৃদয়ে আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহভীতি সঞ্চার করে। তিনি সাহিত্যের মধ্য দিয়ে ইসলামি মূল্যবোধ ছড়িয়ে দিতে সদা সচেষ্ট ছিলেন। তাঁর ‘ঈদে মীলাদুন্নবী কেন?’, ‘নূরে মোস্তফা’ প্রভৃতি রচনায় প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শান ও মিলাদের প্রাসঙ্গিকতা কুরআন-হাদীসের আলোকে পরিস্কারভাবে তুলে ধরেছেন। আল্লামা কাজী নুরুল ইসলাম হাশেমী (রাহ.)-এর রচনার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো তাঁর গবেষণাধর্মী কাজ। ‘আদদুররুদ দালায়িল বেকরাহাটিল জামা‘আতি ফিন নওয়াফিল’ নামক গ্রন্থে তিনি ফিকহি গবেষণায় গভীরতা ও বিশুদ্ধতাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। আর ‘আল আরবাঈন ফি মুহিম্মাতিদ দ্বীন’ গ্রন্থে তিনি ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো হাদীসের আলোকে সংকলন করেন।
তাঁর ‘মিরাজুল মুমিনিন’ ও ‘দোয়ার ভাণ্ডার’ গ্রন্থসমূহে দ্বীনি রূহানিয়াত ও ইবাদতের সৌন্দর্য অত্যন্ত চিত্তাকর্ষকভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। আত্মশুদ্ধির উপায়, নেক আমলের গুরুত্ব, দোয়ার ফজিলত ইত্যাদি বিষয় তিনি সুচিন্তিত ও হৃদয়গ্রাহী ভাষায় তুলে ধরেছেন। তিনি শুধু আকীদা ও ফিকহ নিয়েই লেখেননি, বরং আত্মিক উন্নতির পথও তাঁর লেখায় উজ্জ্বলভাবে ফুটে উঠেছে।
আল্লামা কাজী নুরুল ইসলাম হাশেমী (রাহ.) জীবনীগ্রন্থ রচনার মাধ্যমেও তাঁর ঐতিহ্য, দায়বদ্ধতা ও রূহানী দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটিয়েছেন। ‘আল্লামা এহসানুজ্জামান হাশেমী (রাহ.)’-এর জীবনী এবং ‘তাজকেরাতুল কেরাম (৩য় খণ্ড)’ গ্রন্থে তিনি বুযুর্গানে দ্বীনের জীবনচরিত রচনা করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তরীকতের আদর্শে অনুপ্রাণিত করেছেন।
তাঁর ‘শাজরাতুজ জাহাব’ এবং ‘ওয়াজিফায়ে হাশেমীয়া’ গ্রন্থে তিনি তরীকতের আমল, আখলাক ও আধ্যাত্মিক চর্চার সূক্ষ্ম ও গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন। একজন পীর, মুর্শিদ ও পথপ্রদর্শক হিসেবে তিনি যেসব রূহানী নির্দেশনা দিয়েছেন, তা এসব গ্রন্থে সুশৃঙ্খলভাবে সংকলিত হয়েছে।
আল্লামা হাশেমী (রাহ.) শুধু একজন পাণ্ডিত্যপূর্ণ লেখকই ছিলেন না, বরং ছিলেন এমন একজন চিন্তাশীল আলেম যাঁর লেখায় যুগের চাহিদা ও মানুষের অন্তরের ভাষা প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি সময়োপযোগী বিষয়ের উপর যুক্তি ও দলীলভিত্তিক আলোচনা করে বিভিন্ন বাতিল মতবাদকে পরাস্ত করেছেন এবং হকের পতাকা তুলে ধরেছেন।
তাঁর রচনাগুলো কোনো নির্জীব সাহিত্য নয়, বরং জীবন্ত দিকনির্দেশনা। একজন তালিবে ইলম থেকে শুরু করে সাধারণ মুসলমান – সকল শ্রেণির পাঠকই তাঁর লেখনী থেকে উপকৃত হতে পারে। একদিকে যেমন রয়েছে গভীর ফিকহি বিশ্লেষণ, অন্যদিকে রয়েছে হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা ও আমলের প্রতি উদ্দীপনা।
আল্লামা কাজী নুরুল ইসলাম হাশেমী (রাহ.) ছিলেন একাধারে আলেম, লেখক, দার্শনিক, রূহানী পথপ্রদর্শক এবং আশেকে রাসুল। তাঁর রচনাবলি শুধু বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং পাঠকের অন্তরে চিরস্থায়ী আলো জ্বেলে রেখেছে। তাঁর লেখকসত্তা আজো বাংলার ইসলামি সাহিত্যভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে যাচ্ছে। এমন একজন কালজয়ী লেখক ও আলেম যুগে যুগে মুসলিম উম্মাহর জন্য অনুপ্রেরণার এক অনন্য বাতিঘর হয়ে থাকবে।
লেখক: সভাপতি, মুসলিম হিস্ট্রি এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ। সভাপতি, চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্র, বাংলাদেশ ও সম্পাদক, ইতিহাসের পাঠশালা।
Leave a Reply