আমাদের বাংলার ইতিহাসে এমন কিছু মনীষীর নাম রয়েছে, যাঁরা নিজেদের কর্মগুণে কালের গণ্ডি পেরিয়ে ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছেন। তবে দুঃখজনকভাবে, অনেক গৌরবোজ্জ্বল নাম সময়ের ধুলায় ঢাকা পড়ে গেছে। তেমনই এক বিস্মৃতপ্রায় ব্যক্তিত্ব হলেন চট্টগ্রামের কৃতিসন্তান, আরাকান রাজসভার প্রধানমন্ত্রী ও মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক কোরেশী মাগন ঠাকুর।
তিনি শুধু একজন দক্ষ রাষ্ট্রনায়কই ছিলেন না, ছিলেন একজন কবি, সাহিত্য-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক এবং বহু ভাষায় পারদর্শী একজন জ্ঞানী মনীষী। আজকের প্রজন্মের সামনে তাঁর জীবনী তুলে ধরা শুধু দায়িত্বই নয়, বরং ইতিহাসচর্চার গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবেও বিবেচিত হওয়া উচিত।
কবি কোরেশী মাগন ঠাকুরের জন্ম প্রাচীন চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার চক্রশালা গ্রামে। তাঁর পিতার নাম ছিল বড়াই ঠাকুর (শ্রীবড় ঠাকুর), যিনি নিজেও আরাকান রাজসভার একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী ছিলেন।তাঁর বংশ পরিচয় স্পষ্টভাবে পাওয়া যায় মধ্যযুগীয় মহাকবি আলাওল রচিত ‘পদ্মাবতী’ গ্রন্থে, যেখানে বলা হয়েছে:
“সিদ্দিক বংশেত জন্ম, শেখজাদাজাত
কুলে শীলে সৎকর্মে ভুবন বিখ্যাত।
এক মহাপুরুষ আছিল সেই দেশে,
মহাসত্য মুসলমান সিদ্দিকের বংশে।”
উপরোক্ত পঙক্তি তাঁর ইসলামি পরিচয় ও সিদ্দিক বংশের প্রতি ইঙ্গিত দেয়। বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ, ঐতিহাসিক ড. মুহম্মদ এনামুল হক এবং মুন্সি আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ তাঁদের গবেষণায় নিশ্চিত করেছেন যে কবি মাগন ঠাকুর মুসলমান এবং চট্টগ্রামেরই সন্তান।
আরাকান রাজসভার নেতৃত্ব: ১৭শ শতকে বার্মার (বর্তমান মিয়ানমার) আরাকান রাজ্য ছিল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ একটি অঞ্চল। এর রাজধানী রোসাঙ্গে কোরেশী মাগন ঠাকুর রাজসভার মুখ্যপাত্র (প্রধানমন্ত্রী) হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। রাজা নরপতিগি (শাসনকাল: ১৬৩৮–১৬৪৫ খ্রিস্টাব্দ) তাঁর শেষ বয়সে একমাত্র কন্যার অভিভাবকত্বের দায়িত্ব দেন মাগন ঠাকুরকে। রাজা মৃত্যুবরণ করলে রাজকন্যা শাসনভার গ্রহণ করেন, এবং কোরেশী মাগন ঠাকুর রাজ্য পরিচালনার মূল দায়িত্বে নিযুক্ত হন। তাঁর কূটনৈতিক দক্ষতা, সাংগঠনিক প্রজ্ঞা এবং ভাষাজ্ঞান তাঁকে একজন দূরদর্শী শাসকে পরিণত করে।
সাহিত্য ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক: কবি কোরেশী মাগন ঠাকুরের শাসনকাল ছিল আরাকানে বাংলা সাহিত্যচর্চার এক স্বর্ণযুগ। তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি মহাকবি আলাওল-এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক। তাঁরই অনুপ্রেরণায় রচিত হয় দুটি অমর কাব্য:
পদ্মাবতী (১৬৫২), সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল (১৬৫৯)। এই দুটি গ্রন্থ বাংলা কাব্যসাহিত্যে অনন্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত। কবি মাগন ঠাকুর নিজেও ছিলেন একজন কবি। তাঁর রচিত কাব্য ‘চন্দ্রাবতী’ একটি লোককাহিনিভিত্তিক প্রেমকাহিনী, যেখানে মধ্যযুগীয় বাংলার প্রেম, সমাজ ও সংস্কৃতির বাস্তব প্রতিচ্ছবি উঠে এসেছে। যদিও কাব্যিক উৎকর্ষের দিক থেকে এটি সীমিত, তবে ঐতিহাসিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে এর গুরুত্ব অপরিসীম।
বহুভাষাবিদ ও সংস্কৃতিচর্চার ধারক : কবি কোরেশী মাগন ঠাকুরের অন্যতম বড় গুণ ছিল তাঁর বহুভাষাজ্ঞান। তিনি বাংলা, ফারসি, আরবি, বর্মি এবং সংস্কৃত ভাষায় দক্ষ ছিলেন। এই বহুভাষিক জ্ঞান তাঁকে রাজনীতির পাশাপাশি সাহিত্য, দর্শন, ধর্ম ও সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক অনুধাবনে সক্ষম করে তোলে।
তিনি সঙ্গীত, অলঙ্কারশাস্ত্র ও সাহিত্যের নানা শাখায় পারদর্শী ছিলেন। তাঁর প্রজ্ঞা আরাকান রাজসভার ভাবমূর্তি ও ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করে তোলে। তাঁর সময়ে আরাকান হয়ে উঠেছিল বাংলা ও তৎকালীন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র।
আমাদের চট্টগ্রামের গৌরব: বাংলাদেশ তথা চট্টগ্রামের ইতিহাসে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ দায়িত্বে অধিষ্ঠিত মনীষীদের মধ্যে কবি কোরেশী মাগন ঠাকুর অন্যতম। তাঁর পথ ধরে পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রাম থেকে উঠে এসেছেন: সৈয়দ মীর সাঈদ আলী (গৌড়েশ্বরের উপ-প্রধানমন্ত্রী), ফজলুল কাদের চৌধুরী (পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকার ও ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি), মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন (বাংলাদেশ সরকারের উপ-প্রধানমন্ত্রী), প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস (বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা)। এই মনীষীদের পূর্বসূরি হিসেবে চট্টগ্রামের গৌরব কবি কোরেশী মাগন ঠাকুরের নাম ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকা উচিত। অতচ অনেকে তাঁর নাম ও ইতিহাসও জানে না। কবি ও প্রধানমন্ত্রী কোরেশী মাগন ঠাকুর ছিলেন চট্টগ্রামের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। তাঁর রাষ্ট্রনায়কত্ব, সাহিত্যপ্রীতি, সংস্কৃতির প্রতি দরদ, এবং বহুভাষিক প্রজ্ঞা তাঁকে এক বিরলপ্রজ মানব হিসেবে ইতিহাসে স্থায়ী আসন দিয়েছে। বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের জন্য তাঁর জীবন ও কর্ম এক উজ্জ্বল অনুপ্রেরণা। তাঁকে স্মরণ করা মানেই শুধু একজন ব্যক্তিকে সম্মান জানানো নয়, বরং আমাদের সমৃদ্ধ ইতিহাস ও সংস্কৃতির শেকড়কে পুনরাবিষ্কার করা।
তথ্যসূত্র: ওয়াকিল আহমদ, বাংলা পিডিয়া, বিশ্ব ইতিহাস পরিক্রমা ২০২৪–২০২৫ – সোহেল মো. ফখরুদ-দীন, বুক মিউজিয়াম, ঢাকা, চট্টগ্রামের সোনার মানুষ – সোহেল মো. ফখরুদ-দীন, সাজিদ আলী প্রকাশন,চট্টগ্রাম, বাংলা সাহিত্যে চট্টগ্রামের অবদান – অধ্যাপক শাহেদ আলী,
পাণ্ডুলিপি গবেষণা ও প্রাচীন পুঁথি পর্যালোচনা।
লেখক: সভাপতি, চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্র (সিএইচআরসি), বাংলাদেশ।
Leave a Reply