জামশেদুল ইসলামঃ
অপমৃত্যুর ১৫ ঘটনার তদন্ত হয়েছে মাত্র ৪টি!
চট্টগ্রাম নগরবাসীর জলাবদ্ধতা নিয়ে ক্ষোভ থাকলেও, খাল-নালায় মৃত্যু কারো নজরে পড়ে না। ১০ বছরে চট্টগ্রামে খাল-নালায় পড়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ১৫টি, মারা গেছেন ১৭ জন। কিন্তু এসব ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে কেবল চারটির। প্রথম তদন্ত করা হয়,২০২১ সালে সালেহ আহমেদের মৃত্যুর ঘটনাটি। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারকে তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়। ২ অক্টোবর অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়। কমিটির প্রতিবেদনে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ উভয়কেই দায়ী করা হয়।বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী সাদিয়ার মৃত্যুর পর ক্ষতিপূরণের দাবিতে একই বছরের ২৫ নভেম্বর সাদিয়ার পরিবার এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্র হাইকোর্টে রিট করে। আদালত অবহেলার কারণ অনুসন্ধানের নির্দেশ দেন। উচ্চ আদালতের নির্দেশে জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটিও প্রতিবেদনে সিটি করপোরেশন ও সিডিএ— দুই সংস্থাকেই দায়ী করে। তবে দুই পক্ষই আনুষ্ঠানিকভাবে দায় স্বীকার করেনি।
চট্টগ্রাম নগরবাসীর জলাবদ্ধতা নিয়ে ক্ষোভ থাকলেও, খাল-নালায় মৃত্যু কারো নজরে পড়ে না! অনুসন্ধানে আমরা দেখেছি, গেল আট বছরে খাল-নালায় পড়ে ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। যার অর্ধেকের বেশি শিশু। এই অপমৃত্যুর মাত্র ৪টি ঘটনার তদন্ত হয়েছে। যা মোট ঘটনার মাত্র ২৬ শতাংশ। তাও তদন্ত করতে হয়েছে চাপে পড়ে। বাকিগুলোর চেষ্টাও ছিল না। এমনকি দায়িত্ব অবহেলায় কাউকে শাস্তি পেতে হয়নি। করতে হয়নি জবাবদিহিতা। অথচ ওই সময়ে শুধু খাল-নালা রক্ষণাবেক্ষণে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন খরচ করেছে ১২৭ কোটি টাকারও বেশি। এর বাইরে কেবল জলাবদ্ধতা নিরসনে তিন সংস্থা মিলে (সিডিএ, চসিক ও পানি উন্নয়ন বোর্ড) খরচ করেছে আরও প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা।
চার বছর আগে মুরাদপুর মোড়ের খালপার ধরে যাওয়ার সময় পড়ে গিয়েছিলেন ব্যবসায়ী ছালেহ আহমেদ। এখন পর্যন্ত তার লাশ মিলেনি। সেখানে এখন নিরাপত্তা দেয়াল তোলা হয়েছে। নিখোঁজ ছালেহ আহমেদের ছেলে, সাদেকুল্লাহ মহিম (২৩) দুঃখ করে বললেন, ‘আগেই যদি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হতো, তবে বাবাকে হারাতে হতো না। বাবার তো কোন দোষ ছিল না। শুধু বাবাকেই হারাইনি, হারিয়ে ফেলেছি সব স্বপ্ন। এখন আমরা খুব কষ্টে আছি।ছালেহ আহমেদ নিখোঁজ হবার এক মাস পর, ২৭ সেপ্টেম্বর খালে পড়ে মারা যান আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (আইআইইউসি) কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের ছাত্রী শেহেরীন মাহমুদ সাদিয়া। রাতে তিনি নানা ও মামার সঙ্গে চোখের ডাক্তারকে দেখিয়ে বাসায় ফিরছিলেন। আগ্রাবাদের মাজার গেট এলাকায় ফুটপাত দিয়ে বাসায় ফেরার সময় পা পিছলে নালায় পড়ে যান শেহেরীন। মামা ও নানা সঙ্গে সঙ্গে পানিতে নেমেও তাঁকে খুঁজে পাননি। পরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা রাত তিনটায় তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার করেন।
কতটা অরক্ষিত খাল-নালা
চট্টগ্রাম শহরে প্রধান খাল ও বড় নালা মিলিয়ে আছে প্রায় ২৯১ কিলোমিটার। রাস্তা ও বাড়িঘরের পাশে নালা আছে আরও প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার। ২০২১ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ২১ কিলোমিটার নালা-খালের ৫ হাজার ৫২৭টি ঝুঁকিপূর্ণ স্থান চিহ্নিত করার কথা বললেও সেই রিপোর্টের বিস্তারিত ব্যাখ্যা কোথাও পাওয়া যায়নি। এমনকি রিপোর্টে গবেষণা পদ্ধতি ও ঝুঁকির মাত্রার স্কেল কি কি তাও অজানা। চিহ্নিত এই ৫ হাজার ৫২৭টি ঝুঁকিপূর্ণ স্থানের মধ্যে কতটি স্থানে নিরাপত্তা বেষ্টনী দেওয়া হয়েছে তারও সঠিক পরিসংখ্যান নেই সংস্থাটির কাছে।তবে, গত ১৮ এপ্রিল হিজরা খালে পড়ে ৬ মাসের শিশু মৃত্যুর ঘটনার পর ৪১টি ওয়ার্ডে নালা ও খালের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে সংস্থাটির পরিচ্ছন্ন বিভাগ। সেই তথ্যমতে, শহরের ৩৮৪টি স্থান ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যা এখনো পর্যন্ত অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে।অথচ চট্টগ্রামের ২৪ নম্বর, ৭ নম্বর, ৮ নম্বর ও ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন ঘুরে তালিকার বাইরেও প্রতিটি এলাকায় অন্তত চারটি করে উন্মুক্ত নালা খালের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।তেমনি একটি স্থান নগরের দুই নাম্বার গেটের মেয়র গলি এলাকার পাঁচ নম্বর রোড। ইয়াকুব মসজিদ ধরে সামনে এগোলেই দেখা মিলবে হলুদ রঙের দেয়াল ঘেরা একতলা বাড়ি। বাড়ির গেট থেকে পা বাড়ালেই রাস্তা লাগোয়া ভাঙাচোরা উন্মুক্ত নালা। পথে জমে আছে শ্যাওলা, বৃষ্টি হলে তা আরো পিচ্ছিল হবে। ছোট বা বড় যে কেউ একটু অসতর্ক হলেই পা পিছলে সোজা গিয়ে পড়বে নালায়। দেখতে সাধারণ জায়গা হলেও, বৃষ্টির সময় নালা উপচেপড়ে রাস্তার সঙ্গে মিশে গেলেই মৃত্যুফাঁদ। নালার পাশে নেই কোনো রেলিং, স্ল্যাব বা বাঁধাই করা কিছুই। যা ৪০ মিটার দূরে গিয়ে মিশেছে চশমা খালে।বাড়ির ভেতর থেকেই বেরিয়ে এলেন মাঝবয়সি এক ব্যক্তি। নাম বলতে চাইলেন না। নালার দিকে দেখিয়ে জানতে চাইলাম, ‘নালাতো গেটের পাশেই, অসুবিধা হয় না?’ জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, জায়গাটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। বৃষ্টির সময় কেউ পড়ে গেলে সোজা চলে যাবে চশমার খালে। উদ্ধার করা তো দূরের কথা, খুঁজেও পাওয়া যাবে না। আমরা মহল্লা কমিটিকে অনেকবার বলছি, কেউ পাত্তা দেয় না।নগরের মুরাদপুর, পাঁচলাইশ, শেখ মুজিব রোড, আগ্রাবাদ, খুলশী, বহদ্দারহাট, বাকলিয়া, চকবাজার এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে একই চিত্র। বহু জায়গায় এমন খোলা নালার পাশ দিয়ে পথচারীরা ঝুঁকি নিয়ে চলাফেরা করছে।
বাসা থেকে বের হলেই ঝুঁকিপূর্ণ নালা, অসতর্ক হলেই ঘটতে পারে দুর্ঘটনা।চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী মো. আনিসুর রহমান সোহেল বলেন, ‘শহর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের। কিন্তু আমাদের কিছু আর্থিক ও লজিস্টিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি সব অরক্ষিত জায়গাগুলো রক্ষিত করার কিন্তু কয়েকশ কিলোমিটার নালার নিরাপত্তা বেষ্টনী দিতে ২০০ কোটি টাকা লাগবে। এই টাকা তো সিটি কর্পোরেশনের নাই।ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোতে সতর্কতা সাইনবোর্ড, বাঁশের রেলিং কিংবা লাল পতাকা দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কত কোটি টাকার প্রয়োজন ?— এমন প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তারা।
অপমৃত্যুর সময় দায়িত্বে ছিলেন যারা
আমরা খুঁজে দেখেছি, ২০১৭ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে ১৭টি অপমৃত্যুর সময় সংশ্লিষ্ট এলাকার দায়িত্বে কে ছিলেন। আমরা তাদের নাম সংগ্রহ করি। তাতে দেখা যায়, ২০১৭ সালের ২ জুলাই, রয়েল গার্ডেন কমিউনিটি সেন্টারের পাশের নালায় পড়ে প্রাণ হারান শীলব্রত বড়ুয়া। জায়গাটি ছিল ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের আওতায়। তখন এলাকার দায়িত্বে ছিলেন নির্বাহী প্রকৌশলী আবু সাদাত মো. তৈয়ব। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে ওই ওয়ার্ডের দায়িত্ব পান নির্বাহী প্রকৌশলী ফারজানা মুক্তা।
২০১৮ সালের ৯ জুন, আমিন জুট মিল এলাকায় নালায় পড়ে মারা যায় এক শিশু। তখন ঐ এলাকার দায়িত্বে ছিলেন নির্বাহী প্রকৌশলী আবু সিদ্দিক। এরপর ২০২১ সালের ৩০ জুন, ২৫ আগস্ট ও ৭ ডিসেম্বর ষোলশহর ও মুরাদপুর এলাকায় নালায় পড়ে আরও চারজনের মৃত্যু হয়। তখনও ওই এলাকার দায়িত্বে ছিলেন আবু সিদ্দিক, যিনি ২০২২ সালে অবসরকালীন ছুটিতে যান।একইভাবে ২০২১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ সালের ২৭ আগস্ট ও ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ সালের ৯ এপ্রিল ও ৯ জুন এবং চলতি বছরের ৯ জুলাই আগ্রাবাদ, সদরঘাট, হালিশহর ও বাদশামিয়া ব্রিকফিল্ড এলাকায় নালায় পড়ে মারা যান ছয়জন। ওই সময় এলাকার দায়িত্বে ছিলেন নির্বাহী প্রকৌশলী আনোয়ার জাহান।
ফতেহপুর বাদামতলা এলাকার দায়িত্বে ছিলেন নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ রিফাতুল করিম চৌধুরী, আসাদগঞ্জ ও কাপাসগোলা এলাকার দায়িত্বে ছিলেন নির্বাহী প্রকৌশলী ফারজানা মুক্তা এবং ফিশারিঘাট এলাকার দায়িত্বে ছিলেন নির্বাহী প্রকৌশলী তাসমিয়াহ তাহসীন।যেসকল প্রকৌশলীদের দায়িত্বরত এলাকায় ঘটেছে নালায় পড়ে মৃত্যুর ঘটনা। কথা হয় সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী ফারজানা মুক্তার সাথে। তিনি বলেন, “আমার আওতাধীন যে-সব এলাকায় দুর্ঘটনা ঘটেছে, এর মধ্যে একটি ছিল নতুন দায়িত্ব। সেটা ২০২৪ সালে আসাদগঞ্জের কলাবাগিচা খালে পড়ে যে ছেলেটা মারা যায় সেই এলাকা। ঘটনার এক মাস আগে আমাকে ওই এলাকার দায়িত্ব দেওয়া হলেও তখনো কাজ বুঝে নেওয়া হয়নি। সে সময় দায়িত্বে ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. ফরহাদুল আলম। দুর্ঘটনার পরপরই আমি পরিদর্শনে গিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ব্রিজে বাঁশ দিয়ে রেলিং বসাই। এরপর কাপাসগোলা হিজরা খালে বর্ষা শুরুর আগে তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলীর নির্দেশে এ জোনে বাঁশ দিয়ে ফেন্সিং করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সিডিএ’র জলাবদ্ধতা প্রকল্পের জন্য এ খালের মাটি এস্কেভেটর (খনন যন্ত্র) দিয়ে তোলার সময় অস্থায়ী ফেন্সিং ভেঙে ফেলে। ওই সময়ই এ দুর্ঘটনা ঘটে।অরক্ষিত খাল-নালায় প্রাণহানির ঘটনায় প্রকৌশলীদের দায় কতটা— এমন প্রশ্নের জবাবে তার মত, ‘কোনো মৃত্যুই কাম্য নয়। তবে খাল-নালা সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ একটি ধারাবাহিক কাজ। এখানে শুধু একজন প্রকৌশলী দায়ী নয়, বরং একাধিক বিভাগ ও দপ্তর জড়িত। ড্রেনেজ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সার্কেল নামে একটি সেল রয়েছে, যেটি পরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনার জন্য দায়বদ্ধ। এখানে দুইজন নির্বাহী প্রকৌশলী আছেন এবং সংশ্লিষ্ট জোনের সহকারী প্রকৌশলীও ওই সেলে সংযুক্ত। এ সংক্রান্ত অফিস আদেশ তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলীর দপ্তর থেকে ২০২৪ সালের মে মাসে জারি করা হয়।এ ব্যাপারে কথা হয় সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী আনোয়ার জাহানের সঙ্গে। মুঠোফোনে তিনি বলেন, ‘এগুলো অনেক আগের, বেশিরভাগই আগের ঘটনা। তাই এ ব্যাপারে মন্তব্য করা সবকিছু মিলিয়ে আমার জন্য কঠিন। অনুরোধ করবো, আমাদের প্রধানদের কাছে থেকে মন্তব্য নিতে।নিজের দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকায় ৬ জনের মৃত্যুর বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন—‘অনেকগুলো আগের কেস, অনেকে অবসরেও চলে গেছেন তো তাই বলাটা কঠিন। বিষয়গুলো জেনে হয়তো পরে বলতে পারবো।’
অপমৃত্যুর ১৫ ঘটনার তদন্ত হয়েছে মাত্র ৪টি!
১০ বছরে চট্টগ্রামে খাল-নালায় পড়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ১৫টি, মারা গেছেন ১৭ জন। কিন্তু এসব ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে কেবল চারটির। প্রথম তদন্ত করা হয়,২০২১ সালে সালেহ আহমেদের মৃত্যুর ঘটনাটি। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারকে তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়। ২ অক্টোবর অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়। কমিটির প্রতিবেদনে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ উভয়কেই দায়ী করা হয়।বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী সাদিয়ার মৃত্যুর পর ক্ষতিপূরণের দাবিতে একই বছরের ২৫ নভেম্বর সাদিয়ার পরিবার এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্র হাইকোর্টে রিট করে। আদালত অবহেলার কারণ অনুসন্ধানের নির্দেশ দেন। উচ্চ আদালতের নির্দেশে জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটিও প্রতিবেদনে সিটি করপোরেশন ও সিডিএ— দুই সংস্থাকেই দায়ী করে। তবে দুই পক্ষই আনুষ্ঠানিকভাবে দায় স্বীকার করেনি।
নতুন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর চসিকের তদন্ত
আমরা আট বছরের তথ্য পাই। ২০১৭ সালের ২ জুলাই, সাবেক সরকারি কর্মকর্তা শীলব্রত বড়ুয়া নালায় পড়ে মারা যান। শহরের মোহাম্মদ আলী সড়কের রয়েল গার্ডেন কমিউনিটি সেন্টারের পাশের নালায় পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে ভেসে যান তিনি। পরদিন তার লাশ উদ্ধার করা হয় চাক্তাই খাল থেকে।এর সাত বছর পর, ২০২৫ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন চলতি বছরের দুটি দুর্ঘটনা তদন্ত করে।
১৮ এপ্রিলের দুর্ঘটনার প্রথম তদন্ত
কাপাসগোলায় নবাব হোটেল সংলগ্ন রাস্তায় একটি ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে হিজড়া খালে পড়ে যায়। ছয় মাসের শিশু শেহরিশ,তার মা ও দাদি পরে যান খালে। মা-দাদি রক্ষা পেলেও স্রোতে ভেসে যায় শেহরিশ। ১৪ ঘণ্টা পর চাক্তাই খাল থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। চসিক ২২ এপ্রিল তদন্ত কমিটি গঠন করে। সাত কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা থাকলেও তিন মাস পর তা জমা দেওয়া হয়।
তদন্ত প্রতিবেদনে কমিটি নয়টি কারণ চিহ্নিত করে। সড়ক সংকীর্ণতা, ঢালু রাস্তায় নিরাপত্তাবেষ্টনী না থাকা, সতর্কতামূলক চিহ্নের অভাব, অপর্যাপ্ত আলো, খালের অতিরিক্ত গভীরতা, চালকের অদক্ষতা, অতিবৃষ্টিতে পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়া, স্থানীয়দের সচেতনতার ঘাটতি এবং জরুরি উদ্ধারসেবার দুর্বলতাকে তারা দায়ী করেন। প্রতিবেদনে সরাসরি না হলেও পরোক্ষভাবে দায় ছিল চসিক ও সিডিএ’র।
দ্বিতীয় ঘটনা ৯ জুলাই: নগরের হালিশহরের আনন্দপুর এলাকায় নালায় পড়ে নিখোঁজ হয় তিন বছরের শিশু হুমায়রা। বিকেলে ফায়ার সার্ভিস তার মরদেহ উদ্ধার করে। এ ঘটনায় চসিক তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করে। পরদিন (১০ জুলাই) জমা দেওয়া প্রতিবেদনে নিজেদের কোনো দায় খুঁজে পায় না সংস্থাটি। দায় চাপানো হয়েছে শিশুর পরিবারের উদাসীনতা ও মায়ের কর্মস্থলের অবহেলাকে।
সিডিএ নিশ্চুপ
গত আট বছরে ঘটে যাওয়া ১৫টি ঘটনার কোনোটিই তদন্ত করেনি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিডিএ’র নগর পরিকল্পনাবিদ ঈশা আনসারী বলেন, ‘আমার জানামতে— নালায় পড়ে মৃত্যুর ঘটনায় আমরা আলাদা করে কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করিনি। তবে বিভিন্ন সময়ে নানান কমিটিতে আমাদের কোনো না কোনো প্রতিনিধি হয়তো ছিলেন। এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন নির্বাহী প্রকৌশলী আহমেদ মইনুদ্দিন।’
তবে নির্বাহী প্রকৌশলী আহমেদ মইনুদ্দিনকে মুঠোফোনে যোগাযোগ করেও পাওয়া যায়নি।
খাল–নালায় অপমৃত্যুর দায়—কাদের ঘাড়ে?
চট্টগ্রাম নগরের খাল-নালায় পড়ে মৃত্যুর ঘটনায় দায় কার— এ প্রশ্নে একে অপরের দিকে আঙুল তুলছে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো। চসিকের কর্মকর্তারা দাবি করেন, খাল-নালা রক্ষণাবেক্ষণ ও সুরক্ষা ব্যবস্থার দায়িত্ব তাদের, তবে বেশ কিছু খালের উন্নয়ন কাজ করছে সিডিএ। যেহেতু ৩৬টি প্রধান খালের প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সিডিএ আর সেসব খাল-নালায় পড়ে মৃত্যুর ঘটনার দায়ও তাদের।অপরদিকে সিডিএর প্রকৌশলীরা বলছেন— তারা কেবল প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব চসিকের, তাই দায়ও চসিকের। ফলে সুনির্দিষ্ট দায় নির্ধারণে তৈরি হচ্ছে দ্বন্দ্ব।চসিকের সচিব মোহাম্মদ আশরাফুল আমিন গণমাধ্যম কর্মী কাছে দাবি করেন, কাপাসগোলায় যেখানে হিজরা খালে পড়ে ৬ মাস বয়সি শিশু মারা গেছে, সেটি সিডিএ’র জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতাধীন। এর আগে চশমা খালে সিএনজিচালিত অটোরিকশা উল্টে দুজন মারা গেছেন, সেটিও সিডিএ প্রকল্পের আওতাভুক্ত ছিল। এবার আমরা যে দুটি ঘটনা তদন্ত করেছি সেখানেও আমাদের (চসিকের) কোনো দায় ছিল না।’
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী বলেন, ‘দায় এড়াতে তদন্ত কমিটি করে না চসিক-সিডিএ। স্বাভাবিক বলেই ধরে নিয়ে তারা এসব ঘটনাকে কোনো গুরুত্বই দেয় না। ‘আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছেন’— এমন দৃষ্টিভঙ্গিতেই তারা তদন্ত করে না। চাপে পড়ে যাও দুইটা করেছে তাও দায়সারা ভাবে কাজ করেছে। মিডিয়া আর মানুষকে শান্ত রাখার জন্যই তদন্ত করে। সিডিএ চসিককে দোষারোপ করবে আবার চসিক সিডিএকে দোষারোপ করে আমাদের ব্যস্ত রাখবে। তাদের গাফিলতির কারণে, দায়িত্বে অবহেলার কারণে সাধারণ মানুষের প্রাণ গেছে, এটা তারা মানতে চায় না যে কারণে দায় এড়াতে চায়।’
সাদেকুল্লাহ মহিম, যিনি চার বছর আগে বাবাকে হারিয়েছেন, তিনি বলেন, ‘আমার আব্বুর ঘটনার পরেও খালে-নালায় পড়ে অনেকজন মারা গেছে। তারপরেও তারা (সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ) তৎপর নয়। তারা কোনোভাবেই এটার দায় এড়াতে পারবে না। আমি চাই, আমার বাবার মতো আর কেউ যেন এভাবে নালায় পড়ে মারা না যায়। কেউ বাবা হারা না হোক। যেন চলাচলের রাস্তাটা নিরাপদ হয়। যাদের অবহেলার কারণে আমার আব্বুর মতো আরও মানুষ যারা মারা গেছে তাদের হত্যার যেন বিচার হয়।আগ্রাবাদে নালায় পড়ে মারা যাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী শেহেরীনের বাবা মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘আমার মেয়ে চলে যাওয়ার পর এখানে দেওয়াল উঠেছে, বাতি দিয়েছে। আগে যদি তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতো, লাইটের ব্যবস্থা করতো, ওয়াল দিতো তাহলে আমার মেয়েটা পড়ে মরতো না। আমাকে এলাকার মানুষজন বলছে, আমার মেয়ের আগেও অনেক পড়ছে, হাত পা ভাঙছে, কেউ মারা যায় নাই। আমার মেয়েটাই চলে গেছে।’
মোহাম্মদ আলীর ক্ষোভ, ‘এই ঘটনা যদি বিদেশে ঘটতো তাহলে এতদিনে সব জায়গা সুরক্ষিত হয়ে যাইতো। আর কোনো দুর্ঘটনা ঘটতো না। এই দেশে আইন আছে কিন্তু আইনের প্রয়োগ নাই। এখানে সিটি কর্পোরেশন আর সিডিএর দায়টা বেশি। তারা এখনো অনেক অনেক জায়গায় কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনী দেয়নি। এখনো প্রায় সময় নালায় পড়ে মারা যাওয়ার খবর শুনি।’
আইন কী বলে?
সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩২ অনুসারে নাগরিকের জীবন রক্ষার নিশ্চয়তা দিয়েছে। এ কারণে জননিরাপত্তার ব্যর্থতা রাষ্ট্রের দায় অস্বীকার করা যায় না। অন্যদিকে সিটি করপোরেশন আইন, ২০০৯-এর ধারা ৫০–৫২ অনুসারে নগরের ড্রেনেজ, খাল–নালা রক্ষণাবেক্ষণ ও জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা চসিকের দায়িত্ব। এ ছাড়া দণ্ডবিধি, ১৮৬০-এর ধারা ২৮৮ অনুসারে বিপজ্জনক স্থানে নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করা একটি ফৌজদারি অপরাধ। ধারা ৩০৪(ক) অনুযায়ী অবহেলার কারণে মৃত্যু হলে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা জরিমানার বিধান রয়েছে। এছাড়াও সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা- ২০১৮ অনুযায়ী দায়িত্বে অবহেলার জন্য সরকারি কর্মকর্তাকে সতর্কীকরণ থেকে চাকরিচ্যুতি পর্যন্ত শাস্তি দেওয়া যেতে পারে।আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, নালা–খালে প্রাণহানির দায় বহন করতে হবে প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে উভয়কেই। প্রতিষ্ঠান হিসেবে দায়ী হবে চসিক এবং সিডিএসহ প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা। অন্যদিকে, ব্যক্তিগতভাবে দায়ী হবেন সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী, তত্ত্বাবধায়ক কর্মকর্তা ও জোন অফিসাররা, যাঁদের অবহেলার কারণে এই মৃত্যু ঘটেছে।এ বিষয়ে মানবাধিকার আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটির সদস্য সচিব ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট এ এম জামিউল হক ফয়সাল বলেন,‘খাল-নালার রক্ষণাবেক্ষণ সিটি করপোরেশনের আইনগত দায়িত্ব। প্রতিটি ঘটনায় নিহত ব্যক্তির পরিবার আদালতে মামলা করার অধিকার রাখে। কোনো প্রকৌশলীর অবহেলার কারণে প্রাণহানি ঘটলে বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৩০৪(ক) ধারায় ফৌজদারি মামলা করার সুযোগ রয়েছে। ভুক্তভোগী পরিবার চাইলে সিভিল কোর্টেও ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারে। কিন্তু বাস্তবে এসব ঘটনায় মামলা হয়নি বলেই প্রশাসনিক কিংবা আইনি কোনো জবাবদিহি তৈরি হয়নি।
নজির : দায় নির্ধারণের প্রমাণ আছে
বাংলাদেশে অবহেলার কারণে মৃত্যুর ঘটনায় আদালত একাধিকবার রাষ্ট্র ও কর্মকর্তাদের দায় নির্ধারণ করেছেন। সাভারের রানা প্লাজা ও তাজরীন ফ্যাশনের দুর্ঘটনার মামলায় আদালত স্পষ্ট করেছেন, রাষ্ট্র ও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উভয়ের জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি। এমনকি ভুক্তভোগীর পরিবারকে ১০ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নজিরও রয়েছে। সেই অর্থে নালা–খালের মতো খোলা ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে অবহেলা করলে আইন প্রয়োগ সম্ভব।
একই বিষয়ে চট্টগ্রামের আইনজীবী টিআর খান তাহিম (তৌহিদুর রহমান খান) বলেন, ‘আইন অনুযায়ী কোনো সংস্থা যদি নাগরিকদের নিরাপত্তায় অবহেলা করে, তা হলে সেটি ‘অবহেলাজনিত মৃত্যু’ হিসেবে গণ্য হতে পারে। এই দায় থেকে কেউই মুক্ত নয়, তবে এখন পর্যন্ত কোনো ঘটনায় দায় নিরূপণ বা জবাবদিহি হয়নি। যার কারণে সহজেই দায় এড়িয়ে যায়। আর প্রতিটি ঘটনার পর প্রশাসন সাময়িকভাবে উদ্যোগ নিলেও আগে থেকে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। মানুষ মারা যাওয়ার পরই কেন খালের চারপাশে রেলিং বসানো হয়? তার আগে কেন হয় না?”
অপমৃত্যুর মামলার বাইরে গেল না খাল-নালার প্রাণহানি
দণ্ডবিধির ধারা ৩০৪ (ক) অনুযায়ী যদি কোনো মৃত্যুর ঘটনা গাফিলতির কারণে ঘটে, তবে এ ধরনের ঘটনায় ফৌজদারি মামলা দায়ের করা সম্ভব। চট্টগ্রামের খাল ও নালায় পড়ে মৃত্যুর ঘটনাগুলোতে এই ধারা প্রযোজ্য হওয়ার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও, ১৭ জনের মৃত্যুতে মাত্র ৫টি অপমৃত্যুর মামলা করা হয়েছে, এবং ৬টির কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি থানায়, অর্থাৎ এসকল ঘটনায় কোনো অপমৃত্যুর মামলাও হয়নি। বাকিগুলোর মধ্যে ৫টির তথ্য পুলিশ দিতে পারেনি। এর বাইরে, মাত্র ২টি ঘটনায় ক্ষতিপূরণ চেয়ে রিট করা হয়েছে এবং ১টিতে হাইকোর্টে চার সপ্তাহের রুল জারি হয়েছে। অর্থাৎ অধিকাংশ পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়নি।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রাম নগর পুলিশের ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনে বিভাগে দায়িত্বপালন করা এক কর্মকর্তা বলেন, ‘শুধুমাত্র খাল-নালায় পড়ে মৃত্যুর ঘটনা আমরা আলাদাভাবে নথিভুক্ত করি না। পরিবার চাইলে সাধারণত অপমৃত্যুর মামলা হয়, আবার অনেক ক্ষেত্রে জিডিমূলে লাশ নিয়ে যায়, কোনো মামলা করে না। আপনি যে ঘটনাগুলোর তথ্য জানতে চেয়েছেন সেগুলোর বেশিরভাগই হয়তো এমন ছিল। যেহেতু এগুলো অনেকদিন আগের ঘটনা, তাই সেসব তথ্য আমাদের কাছেও সংরক্ষিত নেই। যেগুলোর তথ্য পেয়েছি তা ইতোমধ্যেই আপনাকে দেওয়া হয়েছে। বাকিগুলো পাওয়ার সম্ভানাও নেই।
রঙ্গীপাড়ায় ১৮ মাসের শিশু ইয়াছিন আরাফাত নালায় পড়ে যায়
চট্টগ্রামের আইনজীবী টিআর খান তাহিম বলেন, ‘আমি সেসময় ভুক্তভোগীর পরিবারকে (বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী শেহরীন মাহমুদ সাদিয়ার পরিবার) অনেক অনুরোধ করেছিলাম বাদী হয়ে মামলা করার জন্য, তাদের বাসায়ও বেশ কয়েকবার গিয়ে অনেক বুঝিয়েছিও যে সিটি কর্পোরেশনের তৎকালীন যে প্রধান প্রকৌশলী ছিলেন তাকে এক নম্বর আসামি করে ৩০৪(ক) ধারায় ফৌজদারি মামলা করার জন্য। কিন্তু তারা মামলা করেনি। পরে শুনলাম এ ঘটনায় তারা একটি রিট করেছে, কিন্তু সেটারও কোনো অগ্রগতি নেই।’
‘সাধারণ নাগরিক কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে মামলা করলে অনেকে মনে করেন এটি মেয়রের বিরুদ্ধে মামলা, আর তখন বিষয়টি ব্যক্তিগতভাবে নেওয়া হয়। অথচ দায়টা আসলে কর্পোরেশনের কর্মকর্তা–কর্মচারীদের। প্রকৌশলী, কাউন্সিলার এবং প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত সবাই এ দায় এড়াতে পারেন না। যদিও এখন কাউন্সিলার নেই, তৎকালীন সময়ে যারা ছিলেন তারাও দায়ী।— যোগ করেন তিনি।খাল নালা রক্ষণাবেক্ষণ খরচের হিসাব নেই চসিকের কাছে!
গত দশ বছরে চট্টগ্রামের খাল-নালার উন্নয়ন ও নিরাপত্তার জন্য কত টাকা বরাদ্দ হয়েছে এবং কীভাবে খরচ হয়েছে, তা জানতে তথ্য অধিকার আইনে চসিকের প্রকৌশল বিভাগের কাছে আবেদন করা হয়। গত ১৭ সেপ্টেম্বর চিঠির মাধ্যমে সংস্থাটি জানায়— খরচের সুনির্দিষ্ট হিসাব নেই।চিঠির জবাবে সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, এই সময়ে নগরে কেবল একটি বিশেষ প্রকল্প চলছিল—বারই পাড়া থেকে কর্ণফুলী খাল খনন প্রকল্প। চট্টগ্রাম সিটির ৫৭টি খালের মধ্যে ৩৬টির উন্নয়ন হচ্ছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বাস্তবায়িত ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ ও সংস্কার’ প্রকল্পের আওতায়। তবে এগুলো এখনো চসিকের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। ঠিকাদার নির্বাচন হয়েছে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েও কার্যকর কোনো প্রকল্প নেই। রেলিং বসানো বা স্ল্যাব/বাঁধাই করা সংক্রান্ত কোনো সুনির্দিষ্ট প্রকল্প প্রণয়ন করা হয়নি। তবে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের বাইরে অরক্ষিত খাল ও নালার পাশে দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য বাঁশের সাময়িক বেষ্টনী তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া প্রায় ৫০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত।
অথচ চসিকের বাজেট বইয়ের তথ্যানুযায়ী, ২০১৭ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত কেবল খাল-নালা মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় করা হয়েছে ১২৭ কোটি ৩ লাখ টাকা। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় আরও হাজার কোটি টাকা খরচ হলেও, প্রকৌশল বিভাগ তার হিসাব দিতে পারেনি। এর বাইরে চলতি অর্থবছরে (২০২৫-২০২৬) আরও ৫০ কোটি টাকা খরচ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সংস্থাটি।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী মো. আনিসুর রহমান সোহেল বলেন, ‘এই হিসাব আমাদের কাছে নেই। এখন এ সংক্রান্ত (খাল নালার নিরাপত্তা, রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত) সব কাজ পরিচ্ছন্নতা বিভাগ করছে। এছাড়াও টিআর, কাবিখা প্রকল্পে খালা নালার জন্য গত চারবছর ধরে সরকার থেকে অনেক টাকা পাচ্ছে। তারাই (পরিচ্ছন্নতা বিভাগ) করছে সব। আমি নতুন এসেছি, তাই গত দশ বছরে কত টাকা খরচ হয়েছে সেটা আমার জানা নেই। আমরা শুধু ১ হাজার ৩৪২ কোটি ২১ লাখ টাকার বারই পাড়া থেকে কর্ণফুলী খাল খনন প্রকল্পেরটা দেখছি।’
অন্যদিকে, রক্ষণাবেক্ষণের বাইরে চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে চারটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বিভিন্ন সংস্থা— এরমধ্যে সিডিএর দুটি, সিটি করপোরেশনের একটি এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি। এসব প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১৪ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকা। গত আট বছরে খরচ হয়েছে ৯ হাজার ৮৫২ কোটি ১৩ লাখ টাকা। দীর্ঘ সাত–আট বছর ধরে কাজ চললেও কোনো প্রকল্পই এখনও পুরোপুরি শেষ হয়নি।
এই চারটির মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয়েছে সিডিএর ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ প্রকল্পে—৫ হাজার ৫৭ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। কর্ণফুলী নদীর তীরে রাস্তা ও জলকপাট নির্মাণে সিডিএর আরেকটি প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৩২৮ কোটি ৫১ লাখ টাকা। সিটি করপোরেশন বহদ্দারহাটের বাড়ইপাড়া থেকে বলিরহাট পর্যন্ত নতুন খাল খননে খরচ করেছে ১ হাজার ২৭০ কোটি ৭৫ লাখ টাকা, আর পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা।
কেউ দায়িত্ব নেয়নি, মেলেনি কোনো ক্ষতিপূরণও!
চার বছর আগে চশমা খালে নিখোঁজ সালেহ আহমেদের ছেলে সাদেকুল্লাহ মহিম বলেন, ‘বাবা চলে যাওয়ার পর প্রথম প্রথম টিউশন করছি। কিছুদিন হলো ছোটোখাটো একটা চাকরিতে ঢুকছি। এই নিয়ে কোনোভাবে চলে যাচ্ছে দিন। প্রথম প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে খালপাড়ে এসে বাবার অপেক্ষায় থাকতাম। এবার আসা হয়নি। একসময় লাশের আশা করতাম। এক বছর, দুই বছর অপেক্ষা করেছি, এখন তাও করি না।’
আইনি পদক্ষেপে নিতে দেরি করার বিষয়ে মহিম বলেন, ‘প্রথমে মামলায় যেতে চাইনি, তারা (তৎকালীন মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী) একটা চাকরি দিবে বলেছিল। সরকারি চাকরি পাবো সে আশায়। পরে তারা চাকরি দিয়েছে ঠিকই, সেটা ছিল পেট্রোল পাম্পে। আমি তখন ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে, সেখান থেকে পড়াশোনা করা কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। কিন্তু আমি একদিন গিয়ে আর যাইনি। সেসময় খুব অনুরোধ করেছিলাম, পিয়নের চাকরি হলেও হবে। যাতে একটু পড়াশোনা করার সুযোগ পাই। আমি আর আমার মা অনেকবার গেছি। কিন্তু অনেকবার ধরনা দিয়েও পাইনি।পরে তদন্তে সিটি কর্পোরেশন আর সিডিএর দায় প্রমাণ পাওয়ার পর আমরা আদালতে ক্ষতিপূরণ চেয়ে রিট করি। আজও সেই রিটের শুনানি হয়নি। হাইকোর্ট চার সপ্তাহের রুল জারি করেছিল, এখন চার বছর পার হয়ে গেছে। কোনো খবর নেই। এ সময়ে কেউ দায়িত্ব নেয়নি, ক্ষতিপূরণও দেয়নি।’
২০২৪ সালের ২৭ মে আসাদগঞ্জের কলাবাগিচা খালে পড়ে মারা যায় কলেজ শিক্ষার্থী আজিজুল হাকিম। কথা হয় তার বাবা কাজী মোহাম্মদ ইকবালের সঙ্গে। হতাশার সুরে তিনি বলেন, ‘সেদিন ছেলেটা আমার নামাজ পড়ার জন্য বের হয়ে আর ফিরে আসেনি। পরে ছোট ছেলের কাছে ফেসবুকে তার মরে যাওয়ার খবর পাই। খালে ডুবেই ছেলেটা মরেছে। কেমনে পড়ছে কিছুই জানি না। সেখান থেকে পড়ছে ওই বিজ্রের অবস্থা খুব খারাপ। শুনেছি, আমার ছেলের আগেও নাকি অনেকে ওখানে পড়ছে। তাদের ভাগ্য ভালো তারা মারা যায় নাই। এখন কার কাছে বলবো? কার কাছে বিচার চাইবো? কপালের লিখন মেনে নেওয়া ছাড়া তো কিছুই করার নাই।’
তবে কেবলমাত্র নিপা পালিতের মৃত্যুর পর ২০২৩ সালের ৮ আগস্ট চসিক থেকে আর্থিক সাহায্য হিসেবে এক লাখ আর শিশু হুমায়রার মৃত্যুর পর চলতি বছরের ৭ আগস্ট ৩০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে।
যা বলছেন বিশেষজ্ঞ
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) স্থাপত্য ও পরিকল্পনা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান বলেন, ‘খাল–নালায় মৃত্যুর ঘটনা বেশিরভাগই চলমান কাজের জায়গায় ঘটছে। সেখানে আগেভাগেই নিরাপত্তা বেষ্টনী, রেলিং বা সতর্কীকরণ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল। স্ল্যাব খুলে রেখে আবার সঠিকভাবে না বসানো কিংবা প্রকল্প এলাকায় সুরক্ষা না থাকায় দুর্ঘটনা ঘটছে—এর দায় প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা, ঠিকাদার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। শুধু সাইনবোর্ড নয়, টিন দিয়ে বেড়া দেওয়া অথবা রেলিং দেওয়া, বাঁশ দিয়ে রেলিং দেওয়া যাতে মানুষজন দূরের থেকে এলার্ট হতে পারে।এত মৃত্যুর দায় কাদের বলে মনে করেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটার দায় যে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থা। অনেক সময় দেখা যায়, বিদ্যমান ড্রেন বা নালাগুলো পরিষ্কার করার জন্য স্ল্যাব তুলে নেয় কিন্তু পরে তা সঠিকভাবে লাগানো হয় না। এরপর প্রচুর বৃষ্টি যখন হয়, জলাবদ্ধতা হয় তখন কেউ হয়তো হেঁটে যাওয়ার সময় অসাবধানতাবশত বা শুকনো সময়ও পড়ে গিয়ে দুঘটর্না ঘটেছে। আর এটার দায় অবশ্যই সংশ্লিষ্ট ওই কর্তৃপক্ষের। যাদের দায়িত্ব ওই ড্রেনগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করা। এখন যদি ওই কাজ করতে সময়ও লাগে তাহলে ওই সময়টুকু পর্যন্ত কোনো নির্দেশনা দিয়ে দেওয়া যাতে এইটা বিপদজনক স্থান তা মানুষ চিহ্নিত করতে পারে। মোটকথা নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাবই মৃত্যুর মূল কারণ। নিয়মিত সেফটি অডিট হলে এসব অপমৃত্যু এড়ানো যেত।’
যা বলছে চসিক-সিডিএ
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও সচিব মোহাম্মদ আশরাফুল আমিন বলেন, ‘এখনো অনেক জায়গা অরক্ষিত রয়েছে তবে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমরা একটা কল সেন্টার চালু করেছি, বিজ্ঞাপন দিয়েছি, অলিগলিতে উন্মুক্ত থাকার খবর পেলে ব্যবস্থা নিচ্ছি, এটা চলমান আছে।দায় এড়ানোর প্রবণতা নিয়ে নাগরিকরা যে সমালোচনা করে, সেটা কীভাবে দেখেন?— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘না, না প্রতিষ্ঠানের কোনো গাফিলতি ছিল না। ওই জায়গায় পানি উঠেছে তাহলে সেখানে সে যাবে কেন? আগে তো মানুষকেই সচেতন হতে হবে। তাও আমরা দায়িত্ব নেওয়ার তদন্ত করে সে সুপারিশ অনুযায়ী কাজ করছি।’
তিনি দায়িত্বে থাকাকালীন ২০২৪ সালেই নালায় পড়ে চারটি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে— উল্লেখ করা হলে এ কর্মকর্তা বলেন, ‘সেসময় এটা মেয়রের উপর নির্ভর করেছে। তিনি কেন করেন নাই তা তো বলতে পারবো না।এদিকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান পরিবর্তন হওয়ায় দীর্ঘদিন দায়িত্বে থাকা প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামসের বক্তব্য নেয়া হয়। এ বিষয়ে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি প্রশ্ন শেষ করার আগেই বলেন, ’এখানে অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে। ১৭ জনের ঘটনা এক নাকি? ১৭ জনের সতেরো রকম। এই বিষয়ে আপনি চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলেন।’
Leave a Reply