শুদ্ধ রাজনীতির প্রতীক : ভাষাসৈনিক মাওলানা আহমুদুর রহমান আজমী
-সোহেল মো. ফখরুদ-দীন
একটি জাতি যখন আপন পথ হারিয়ে ফেলে, তখন তাকে আশ্রয় নিতে হয় ইতিহাসের ছায়ায়—সেইসব মানুষদের স্মরণে, যাঁরা জাতির জন্য নির্মাণ করেছেন নৈতিকতার ভিত্তি। আজ আমরা এমন এক মানুষকে স্মরণ করছি, যাঁর জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল সত্য, ন্যায় ও মানবতার পক্ষে। তিনি কেবল রাজনীতিক ছিলেন না, ছিলেন এক আদর্শিক বিপ্লবী, ভাষা আন্দোলনের সৈনিক, প্রগতিশীল চিন্তক ও সমাজগঠনের কারিগর। তিনি মাওলানা আহমুদুর রহমান আজমী—চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ের এক মহান সন্তান, যাঁর জীবন আজও আমাদের জাতীয় জীবনে প্রাসঙ্গিক, প্রয়োজনীয় এবং প্রেরণাদায়ী।
১৯২৮ সালের ২ নভেম্বর চট্টগ্রামের মীরসরাই উপজেলার ইছাখালি ইউনিয়নের দেওখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মাওলানা আজমী। তাঁর পিতা ছিলেন একজন সর্বজন শ্রদ্ধাশীল আলেম এবং মাতাও ছিলেন ধর্মভীরু ও নীতিবান নারী। পরিবার থেকেই তিনি পেয়েছিলেন নৈতিক শিক্ষা ও সামাজিক দায়িত্ববোধের বীজ, যা পরবর্তী সময়ে তাঁকে গড়েছে আদর্শিক রাজনীতির এক দুর্ভেদ্য মূর্তিতে। ছাত্রজীবনে হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে উচ্চতর ইসলামি শিক্ষা গ্রহণের সময় থেকেই তাঁর মাঝে রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটতে থাকে। ১৯৪৮-৫২ সাল সময়কাল ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভাষা নীতি নিয়ে বাঙালির ঘোরতর প্রতিবাদের সময়। সে সময় হাটহাজারী মাদ্রাসার ছাত্র হয়েও তিনি রাজপথে সক্রিয় ছিলেন। প্রতিদিন ক্লাস শেষে চট্টগ্রাম শহরে এসে ভাষা আন্দোলনের সভা-সমাবেশে যোগদান করে আবার রাতেই মাদ্রাসায় ফিরতেন। এক অদম্য সাহস ও দায়িত্ববোধই তাঁকে এ কঠিন পথচলায় নিয়োজিত করেছিল। চট্টগ্রামে ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে দুইটি প্রধান সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্র ছিল—‘সীমান্ত’ ও ‘উদয়ন’। মাওলানা আজমী ছিলেন এই দুটি প্রকাশনার সাথে যুক্ত প্রগতিশীল ছাত্রদের অন্যতম। তাঁর নেতৃত্বেই হাটহাজারীতে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়, যেখানে তিনি আহ্বায়ক এবং সেই সময়ের স্কুল ছাত্র শাহাবুদ্দীন ছিলেন সম্পাদক। তাঁর কাজ, নেতৃত্ব ও লেখনী চট্টগ্রামের ভাষা আন্দোলনকে একটি সাংগঠনিক কাঠামো দেয়। রাজনীতিতে তাঁর পরবর্তী যাত্রাপথ ছিল আরও বিস্তৃত ও সংগ্রামী। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে সক্রিয়ভাবে কাজ করে গণতান্ত্রিক কর্মীশিবিরের যুগ্ম আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগ দিয়ে জেলা শাখার অফিস সম্পাদক হন এবং ১৯৫৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে প্রতিনিধি হিসেবে অংশ নেন, যেখানে দলটি অসাম্প্রদায়িক আদর্শ নিয়ে ‘আওয়ামী লীগ’ নাম ধারণ করে। তাঁর রাজনৈতিক জীবন মূলত পরবর্তী সময়ে কেন্দ্রিত হয় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)-এর চারপাশে। অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের নেতৃত্বাধীন ন্যাপে তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক এবং একটানা ৩৭ বছর এই দলের সাথে যুক্ত ছিলেন। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, রাজনৈতিক দমননীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, এবং ১৯৫৮ সালে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের শাসনামলে গ্রেফতার হয়ে ১৩ বছর কারাবরণ—সব কিছুই ছিল তাঁর জীবনের অঙ্গ। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ন্যাপ (মোজাফ্ফর) থেকে মীরসরাই আসনে প্রার্থী হন তিনি এবং ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। আগরতলার মনুবাজার ক্যাম্পে দায়িত্ব পালন করেন ক্যাম্প ইনচার্জ হিসেবে। তাঁর এই ভূমিকা ছিল নিঃশব্দ অথচ গুরুত্বপূর্ণ। বিজয়ের পর দেশে ফিরে তিনি দেশ পুনর্গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭৪ সালে গঠিত বাকশাল-এ তিনি যোগ দিয়ে চট্টগ্রাম জেলা কমিটির অন্যতম সম্পাদক হন। এই সময়েও তাঁর রাজনীতি ছিল জনমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় নিবেদিত। ব্যক্তি জীবনে তিনি ছিলেন বিনয়ী, অনাড়ম্বর এবং লোভ-লালসা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। তিনি কোনোদিন ক্ষমতা বা পদবির আশায় রাজনীতি করেননি—রাজনীতি তাঁর কাছে ছিল একটি ‘ইবাদত’। ২০১১ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি রাতে তিনি মারা যান। কিন্তু ইতিহাস তাঁকে ভুলে যায়নি। মৃত্যুর দুই বছর আগে চট্টগ্রামের ডিসি হিলের একুশের বইমেলায় তাঁকে দেওয়া হয়েছিল ‘অমর একুশে স্মারক সম্মাননা’, যা ছিল জাতির পক্ষ থেকে এক নীরব শ্রদ্ধাঞ্জলি।আজকের বাস্তবতায়, যখন রাজনীতি হয়ে উঠেছে সুবিধাবাদের কারখানা, তখন মাওলানা আজমীর মতো আদর্শিক নেতাদের স্মরণ এক ধরণের আত্মশুদ্ধির অনুশীলন। তাঁর ত্যাগ, নিষ্ঠা ও নীতির প্রতি অঙ্গীকার আমাদের মনে করিয়ে দেয়—রাজনীতি অর্থ কেবল ক্ষমতা নয়, এটি হতে পারে মানবতার এক নির্মল প্রয়াস।আমরা গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করি এই ভাষা সৈনিক, আদর্শবাদী রাজনীতিক ও দেশপ্রেমিক মানুষটিকে। আল্লাহ তাআলা তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌসের সর্বোচ্চ স্থানে আসীন করুন। আমিন।
লেখক : ইতিহাস গবেষক, কলাম লেখক ও সমাজচিন্তক। চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ।
Leave a Reply