প্রাচীন বাংলার আধ্যাত্মিক ইতিহাসে সুফি সাধকদের অবদান অপরিসীম। বিশেষত প্রাচীন ঢাকা নগরীর ইসলাম প্রচার ও সংস্কৃতিতে তাঁদের ভূমিকা যুগে যুগে আলোচিত হয়ে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় আজকের ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে হাইকোর্ট মাজার নামে খ্যাত যে ঐতিহাসিক স্থাপনা অবস্থিত, তা হলো মহান অলী হযরত খাজা শাহ শরফুদ্দিন চিশতি (রাহ:)–এর পবিত্র মাজার শরীফ।
ঐতিহাসিক সূত্র অনুযায়ী, হযরত শাহ শরফুদ্দিন চিশতি (রাহ:) ১৬শ শতকের শেষভাগে বাদশাহ আকবরের শাসনামলে ঢাকায় আগমন করেন। অনেকে তাঁকে শাহ জালাল ইয়ামেনী (রাহ:)–এর সফরসঙ্গী বলে উল্লেখ করেছেন, আবার অন্য সূত্রে বলা হয় তিনি আজমীরের খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রাহ:)–এর উত্তরসূরি হিসেবে বাংলায় আসেন। যেভাবেই হোক, তাঁর আগমন ঢাকার ইসলামী ইতিহাসে আধ্যাত্মিক বিকাশের এক অনন্য অধ্যায় সূচিত করেছিল।
চিশতিয়া তরিকার মূল শিক্ষা ছিল— আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা, প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা:)–এর সুন্নাহর অনুসরণ, মানবকল্যাণে আত্মনিয়োগ।
এই আদর্শ ধারণ করে হযরত শাহ শরফুদ্দিন চিশতি (রাহ:) দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন, অতিথি ও পথিকদের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন, এবং মসজিদ-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইসলামের শিক্ষা প্রচার করেছেন। ঢাকার হাইকোর্ট–সুপ্রিম কোর্ট ভবনের পাশে অবস্থিত এই পবিত্র মাজার শরীফ আজও আধ্যাত্মিকতার আলোকবর্তিকা। সরকারি দলিল অনুসারে, প্রায় ১৭ শতাংশ জমির ওপর রয়েছে তাঁর কবরস্থান, একটি পাকা মাজার ও দক্ষিণমুখী দুটি প্রাচীন ইঁদারা।এখানে প্রতিদিন হাজারো মানুষ ভিড় করেন—ভক্ত, দরবেশ, পথচারী ও ভবঘুরেরা। একসময় লঙ্গরখানায় গরীব-অসহায়দের জন্য খাবারের ব্যবস্থা থাকত। বর্তমানে মাজার কমিটির উদ্যোগে মসজিদ, মাদ্রাসা, পাঠাগার, লঙ্গরখানা ও জনকল্যাণমূলক নানা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, সুপ্রিম কোর্টের একজন মাননীয় বিচারপতি পদাধিকারবলে এ কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। মাজার শরীফ কেবল ধর্মীয় কেন্দ্র নয়, এটি ঢাকার ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতীক। ইসলামের আলোকে গড়ে ওঠা এই তীর্থস্থান আমাদের জাতীয় পরিচয়ের সাথেও জড়িত।
চিশতিয়া তরিকার মূল বার্তা হলো দয়া, দানশীলতা ও মানবপ্রেম। হযরত শাহ শরফুদ্দিন চিশতি (রাহ:)–এর জীবনকর্ম থেকে আমরা শিখতে পারি যে, ইসলামের শক্তি কেবল অস্ত্র বা রাজনৈতিক ক্ষমতায় নয়, বরং দাওয়াত, দয়া ও মানবকল্যাণে নিহিত। এজন্য আজও মানুষ তাঁর প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে আসছে।
সাম্প্রতিক বিতর্ক ও জনগুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন: সম্প্রতি হাইকোর্ট মাজার ও মসজিদ অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার দাবি জানিয়ে এক আইনবিদ সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছেন। তিনি যুক্তি দিয়েছেন যে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ও আগামীতে ক্ষতি হতে পারে। এই আবেদনের সুত্র ধরে বাংলাদেশ জাতীয় পত্রিকা ও অনলাইন নিউজ এজেন্সিতে সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে। পত্রিকার সংবাদ দেখে বাংলাদেশের ইসলামীচিন্তাবিদ, সুন্নীও সুফিজনতা তিব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে। এই অন্যায় দাবির প্রেক্ষিতে মুসলিম হিস্ট্রি এসোসিয়েশন বাংলাদেশ এক বিবৃতি দিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়— ” হাইকোর্ট মাজার বাংলাদেশের মুসলিম ইতিহাস ও ঐতিহ্যের গৌরবময় সাক্ষী, এটি কোনো দিন, কোনোভাবে রাষ্ট্র বা সমাজের ক্ষতি করেনি, সুফিবাদে শান্তির ধর্ম ইসলাম প্রচারে এই মাজারের অবদান অপরিসীম।
এমন প্রেক্ষাপটে সংগঠনটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনুস বরাবর ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ একটি স্মারকলিপি প্রদান করে ” । ঢাকার এই প্রাচীনতম সুফি মাজার ও মসজিদকে সংরক্ষণ করা রাষ্ট্রের নৈতিক ও সাংবিধানিক দায়িত্ব। যেমনভাবে আমরা ঐতিহাসিক স্থাপনা, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ বা ভাষা শহীদদের স্মৃতিচিহ্ন রক্ষা করি, তেমনি ইসলামী ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে হাইকোর্ট মাজারও সংরক্ষিত হওয়া উচিত। হযরত খাজা শাহ শরফুদ্দিন চিশতি (রাহ:) ছিলেন এক মহান সুফি সাধক, যিনি প্রাচীন ঢাকায় ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর জীবন ও শিক্ষা মানবতার জন্য অনন্য দৃষ্টান্ত। আজ যখন আধুনিক নগরায়ণ ও প্রাতিষ্ঠানিক সংকটের কারণে মাজারটি নিয়ে বিতর্ক উঠেছে, তখন প্রয়োজন ঐতিহাসিক প্রমাণ ও জনগণের অনুভূতিকে সম্মান জানানো। হাইকোর্ট মাজার শুধু একটি ধর্মীয় স্থান নয়, বরং এটি ঢাকার আত্মার অংশ, ইসলামের আলো এবং আমাদের সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী স্মারক। তাই একে সংরক্ষণ করা আমাদের সকলের ও রাষ্ট্রের গুরু দায়িত্ব।
তথ্যের জন্য ঋন স্বীকার : দেওয়ান নুরুল আনোয়ার হোসেন চৌধুরী, বাংলাপিডিয়া। উইকিপিডিয়া, বাংলা পোস্ট বিডি, দৈনিক স্বাধীন কাগজ,দৈনিক পূর্বদেশ, সুন্নী বার্তা, জাগো নিউজ ২৪ ডট কম, Lawyers clvb Bangladesh. com.
লেখক: সভাপতি, মুসলিম হিস্ট্রি এসোসিয়েশন বাংলাদেশ, সম্পাদক ও পরিচালক, ইতিহাসের পাঠশালা।
Leave a Reply