অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর জাতির উদ্দেশে প্রথম ভাষণ দিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে যে জনগণের অধিকার নিশ্চিত করা- এই ভাষণটি জাতির জীবনে এক মাইলফলক হিসেবে চিরকাল স্মরণীয় থাকবে। একজন নিরপেক্ষ সরকার প্রধানের বক্তব্য কেমন হওয়া উচিত, তা এই ভাষণের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের নানা কর্মপরিকল্পনা নিয়ে তিনি একটি ধারণা দেন এই ভাষণে। ড. ইউনূস বলেন, বিপ্লবী ছাত্র-জনতা জাতির এক ক্রান্তিলগ্নে আমাকে এক গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেছে। তারা নতুন এক বাংলাদেশ গড়তে চায়। নতুন প্রজন্মের এই গভীর আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার সংগ্রামে আমি একজন সহযোদ্ধা হিসেবে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছি। দেশের সব বয়সের, সব পেশার, মতের, সব ধর্মের সবাইকে বিনা দ্বিধায় এই সংগ্রামে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।
তিনি বলেন, লাখ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়, লাখ লাখ মা বোনের আত্মত্যাগের বিনিময় যে বাংলাদেশ আমরা পেয়েছিলাম তা ফ্যাসিবাদ এবং স্বৈরাচারের হাতে ধ্বংস হয়ে গেছে। আপনারা দেখেছেন আমাদের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে তারা কীভাবে শেষ করেছে। দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে দুর্নীতি। এমন এক দেশে আমাদের দেশ রূপান্তরিত হয়েছে, যেখানে স্বৈরাচারের পিয়নও দুর্নীতির মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার সম্পদ করার মতো অকল্পনীয় কাজ করে গেছে নির্বিবাদে। শিক্ষা খাতকে পঙ্গু করে দিয়েছে, ব্যাংকিং ও শেয়ার বাজার খাতে লুটপাট, প্রকল্প ব্যয়ে বিশ্বরেকর্ড, অবাধ সম্পদ পাচার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাকে নিজ দলের পুতুলে রূপান্তর, বাকস্বাধীনতা হরণ, মানবাধিকার হরণ এসবই হিমশৈলের অগ্রভাগ মাত্র। ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে ফ্যাসিবাদী সরকার খর্ব করেছে জনগণের সাংবিধানিক ক্ষমতা ও অধিকার। দুঃশাসন, দুর্নীতি, অন্যায়-অবিচার নিপীড়ন, বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যম জনসুরক্ষা বিপন্ন করেছে। জনগণকে নির্যাতন, বঞ্চনা ও বৈষম্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। নতুন প্রজন্মের মানুষসহ কোটি কোটি মানুষের ভোটাধিকারকে বছরের পর বছর হরণ করেছে। মানুষের এগিয়ে যাওয়ার পথে সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে স্বৈরাচার তার নিজের, পরিবারের ও দলের কিছু মানুষের হাতে দেশের মালিকানা তুলে নিয়েছে।
ছাত্র-জনতার বিপ্লবকে নস্যাৎ করতে যে শত শত মিথ্যা ও হয়রানি মূলক মামলা দায়ের করা হয়েছিল তার অধিকাংশ প্রত্যাহার করেছি এবং আটক ছাত্র জনতার মুক্তি লাভের ব্যবস্থা করেছি। পর্যায়ক্রমে মিথ্যা ও গায়েবি সকল মামলার ক্ষেত্রে অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করে মানুষকে দুঃসহ ভোগান্তি থেকে মুক্ত করা হবে। ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে গণ-অভ্যুত্থানে সব শহীদের পরিবারকে পুনর্বাসন করা হবে। আহত সব শিক্ষার্থী ও জনতার চিকিৎসার সম্পূর্ণ ব্যয় সরকার বহন করবে। সে লক্ষ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে উপদেষ্টা পরিষদে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিত্বকারী দুই জন উপদেষ্টার সহায়তায় একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে।
এই কার্যক্রম চালিয়ে নিতে ও গণ-অভ্যুত্থানের শহীদদের স্মৃতি ধরে রাখতে সরকার অতি দ্রুত ‘জুলাই গণহত্যা স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ নামে একটি ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করার প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে এনেছে। আপনাদের সবার এবং বিদেশে অবস্থানরত ভাই-বোনদের অনুদান এই প্রতিষ্ঠানে পাঠানোর জন্য অনুরোধ করছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান পদ গ্রহণ করেছি।তিনি বলেন, দায়িত্ব গ্রহণ করেই আমাদের আইনশৃঙ্খলা অঙ্গনে অস্থির পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়েছে। আপনাদের সহযোগিতা ও সমর্থনে দেশপ্রেমিক সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজে যোগ দিয়েছে। ফ্যাসিবাদী সরকার প্রশাসনে চরম দলীয়করণ করার ফলে বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী দীর্ঘদিন বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। আমরা ইতোমধ্যে সংশোধন মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে আরম্ভ করেছি। তবে প্রশাসনকে গতিশীল রাখতে এবং একইসঙ্গে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সময় প্রয়োজন। সেজন্য সকলকে ধৈর্য ধরার অনুরোধ জানাচ্ছি। প্রশাসনের সবল ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান গুলো যেন জনগণের আস্থা ফিরে পায় সেটি আমাদের অন্যতম উদ্দেশ্য।ব্যাংকিং খাতে সুশাসন
লুটপাট ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করা ব্যাংকিং খাতে সুশাসন নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিয়েছেন উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এই খাতে দক্ষ জনবল নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা স্থাপন, ব্যবসা বাণিজ্যের সহায়ক পরিবেশ তৈরি এবং জনগণের জীবনযাপন সহজ করতে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার আমরা উদ্যোগ সচল করেছি।
ব্যাংকিং খাতে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের জন্য ব্যাংক কমিশন গঠন করা হবে। আর্থিক খাতে সার্বিক পরিস্থিতি এবং সংস্কার বিষয়ে একটি রূপকল্প তৈরি করা হবে, যা দ্রুত জনসম্মুখে প্রকাশ করা হবে। শেয়ার বাজার, পরিবহন খাতসহ যেসব ক্ষেত্রে চরম বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে, তা নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও জবাবদিহি
বিচার বিভাগকে দুর্নীতি ও দলীয় প্রভাবমুক্ত করতে কার্যক্রম শুরু হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, একটি সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ফ্যাসিবাদী সরকারের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, খুন, অপহরণ এবং আয়নাঘরের মতো চরম ঘৃণ্য সব অপকর্মের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে। এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত সকলের বিচার নিশ্চিত করা হবে। তালিকা প্রস্তুত করে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করা হবে। দুর্নীতি ও সম্পদ পাচারের বিচার করা হবে।পুলিশ কমিশন
প্রধান উপদেষ্টা বলেন,আইনশৃঙ্খলার ক্ষেত্রে জনমুখী ও দলীয় প্রভাবমুক্ত ও জবাবদিহিমূলক কাঠামো সৃষ্টির লক্ষ্যে পুলিশ কমিশন গঠন করা হবে। জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদন, দায়িত্বপ্রাপ্ত সকল সংস্থা ও জনগণের সাথে মতবিনিময়ের মাধ্যমে কমিশনের নেতৃত্বে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে। বাংলাদেশকে আর কোনও দিন কেউ যেন কোনও পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত না করতে পারে, তার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তথ্যের অবাধ প্রবাহ
ড. ইউনূস বলেন, তথ্যের অবাধ প্রবাহ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে।ফ্যাসিবাদী সরকার গণমাধ্যমের ওপরও দলীয়করণ ও নির্যাতনের বোঝা চাপিয়েছিল। জনগণের তথ্যের অধিকার নিশ্চিত করতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তথ্যের প্রবাহে বিদ্যমান আইনি ও অন্যান্য বাধা অপসারণ করা হবে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত করে এমন সব আইনের নিপীড়ন মূলক ধারা সংশোধন করা হবে। ইতোমধ্যে এ ধরনের আইনগুলো চিহ্নিত করে এই প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে।
বিদেশি সংবাদ কর্মীদের এ দেশে আসার ওপর যে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা ছিল, ইতোমধ্যে আমরা তা তুলে নিয়েছি। বিদেশি সাংবাদিকদের দ্রুত ভিসা দিতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমরা আশা করি পরিবর্তিতন পরিস্থিতিতে গণমাধ্যম কর্মীরা নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা চালিয়ে যাবেন। শিক্ষাক্ষেত্রে সংস্কার শিক্ষাক্ষেত্রে চরম নৈরাজ্য প্রতিষ্ঠিত করে গেছে বিগত সরকার, এ কথা উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, আমরা তার পূর্ণাঙ্গ সংস্কারের উদ্যোগ নেবো। এটা আমাদের অন্যতম অগ্রাধিকার। আপনারা জানেন, দায়িত্ব গ্রহণের পর দ্রুততম সময়ের মধ্যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের জন্য সৃজনশীল, নিরাপদ ও ভীতিমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা আমাদের অঙ্গীকার। একইসাথে পাঠ্যক্রমকেও যুগোপযোগী করার কাজও দ্রুত শুরু করা হবে।গণতন্ত্র সুসংহত গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা হবে এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করা হবে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানকে সফল পরিণতি দিতে প্রশাসন, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনি ব্যবস্থা,আইনশৃঙ্খলা খাত এবং তথ্য প্রবাহে প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পূর্ণ করে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণ মূলক নির্বাচন আয়োজন করা হবে। এর লক্ষ্য হবে দুর্নীতি, লুটপাট ও গণহত্যার বিরুদ্ধে একটি জবাব দিহিমূলক রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সূচনা।
বর্তমান সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান গ্রহণ করেছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাদের সম্পদের বিবরণ প্রকাশ করবেন। কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রেও নিয়মিত এবং বাধ্যতামূলক করা হবে।
আমাদের সব উপদেষ্টা পর্যায়ক্রমে সব সরকারি ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন। সংবিধানের ৭৭ অনুচ্ছেদে প্রতিশ্রুত ন্যায়পাল নিয়োগে অধ্যাদেশ প্রণয়ন করা হবে।
কৃষি-স্বাস্থ্য-পরিবেশ
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, কৃষিনির্ভর বাংলাদেশে কৃষকের স্বার্থ যেন স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে, কৃষক যেন তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পায় তা নিশ্চিত করা হবে। প্রবাসী শ্রমিকরা যেভাবে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনকে সমর্থন দিয়েছেন, মুক্তিকামী জনগণ তা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করে। তাদের প্রতি সকল পর্যায়ে সম্মানজনক আচরণ নিশ্চিত করা হবে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত খাত। জনগণের জন্য পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য খাতে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে। এই খাতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনা হবে। হাসপাতালগুলোকে আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে এবং সেখানে সরকারি ডাক্তারসহ বিশেষজ্ঞদের নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করা হবে। স্বাস্থ্যসেবা যাতে নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত না থাকে, দেশের সব অঞ্চলের মানুষ সমান স্বাস্থ্য সেবা পায়, সে লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে আমরা বদ্ধপরিকর। বর্তমান প্রজন্ম অনেক বেশি সচেতন এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে যাওয়া পরিবর্তন বিষয়ে তারা ওয়াকিবহালই শুধু নয়, তারা নেতৃত্ব দিচ্ছে। তারা যে উন্নয়নের স্বপ্ন দেখে তা টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব। প্রকৃতি ধ্বংসকারী উন্নয়ন নয়। শুধু জিডিপি একটি দেশের উন্নয়নের মাপকাঠি হতে পারে না। নদী-নালা, খাল-বিল, পাহাড়, বন, মাটি আর বাতাস ধ্বংস আর দূষিত করে যে উন্নয়ন হয় তা দীর্ঘমেয়াদি টেকসই নয়। জীবাশ্ম জ্বালানির বিরুদ্ধে পরিবেশবাদীদের সঙ্গে আমাদের সরকারের অবস্থান সামঞ্জস্যপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করতে এবং আগামী প্রজন্মের জন্য সুস্থ একটি পৃথিবী রেখে যেতে কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার বিকল্প নেই। আমাদের সরকার পরিবেশ ও জলবায়ু রক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবে। এই কার্যক্রমে তরুণ সম্প্রদায়কে সম্পৃক্ত করা হবে।
পররাষ্ট্রনীতি
ইতোমধ্যে বিভিন্ন রাষ্ট্র ও জাতিসংঘ বর্তমান সরকারের কর্মসূচির প্রতি সমর্থন জানিয়েছে উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, আমরা সব রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখবো। আমাদের পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি হবে পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস ও সহযোগিতা। আমরা মানবাধিকার আইনসহ সব আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আমাদের পক্ষ থেকে গুম বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তির পক্ষরাষ্ট্র হওয়াসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে পক্ষভুক্ত এমন সব আঞ্চলিক ও দ্বিপাক্ষিক চুক্তি ও সমঝোতা বাস্তবায়ন করে যাবো আমাদের সরকার রোহিঙ্গা সমস্যার বাস্তবসম্মত সমাধানের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে কাজ করে যাবে।
জাতীয় সংহতি উন্নয়ন তিনি বলেন, আমরা জাতীয় ঐক্যে বিশ্বাসী। প্রয়োজনীয় সংস্কারের লক্ষ্যে রাজনৈতিক ঐক্যর মধ্য দিয়ে নিশ্চিত করা হবে নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু,আদিবাসী সকলেই এ দেশের নাগরিক এবং সমান আইনের সুরক্ষার অধিকারী। তাদের সকলের মানবিক অধিকারসহ অন্যান্য সকল অধিকার নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। এ জন্য আমি উপদেষ্টা পদমর্যাদা সম্পন্ন একজন বিশেষ সহকারী নিয়োগ দিয়েছি, যার দায়িত্ব হবে জাতীয় সংহতি উন্নয়ন।
বন্যা নিয়ন্ত্রণ
বন্যাকবলিত এলাকার সকল মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে সঠিক সহায়তা দেওয়ার জন্য সরকারের যত কার্যক্রম আছে তাদের সচল করেছি। ইতোমধ্যে উপদেষ্টাবৃন্দ বিভিন্ন এলাকার দায়িত্ব নিয়ে এলাকায় গেছেন। আমার কার্যালয়ে একটা নিয়ন্ত্রণকক্ষ স্থাপন করা হয়েছে। বন্যা পরবর্তী কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে এবং ভবিষ্যতে বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য করণীয় কি স্থির করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কলঙ্কিত দেখতে চাই না
ড, ইউনূস বলেন, দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী, পুলিশ বিজিবি, র্যাবকে গুম, নির্যাতনের কাজে লাগিয়ে তাদের কলঙ্কিত করা হয়েছে। তারা দেশের গৌরব। তাদেরও কিছু অতি উৎসাহী সদস্যের কারণে পুরো বাহিনীকে আমরা কলঙ্কিত দেখতে চাই না। আমরা অপরাধীদের চিহ্নিত করতে চাই এবং তাদের শাস্তি দিতে চাই। যেন ভবিষ্যতে কারও হুকুমে দেশপ্রেমিক কোনও বাহিনীর, পুলিশের, র্যাবের কোনও সদস্য হত্যাকাণ্ড, গুম ও অত্যাচারে জড়িত হওয়ার সাহস না করে, তাদের কাছে হুকুম যত বড় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেই আসুক না কেন, তারা তা উপেক্ষা করবে। ভবিষ্যতে ওপরওয়ালার হুকুমে এমন ঘৃণ্য কাজ করতে বাধ্য হয়েছে, এমন ব্যাখ্যা কারও কাছে গৃহীত না হয় তার ব্যবস্থা করা হবে।আমি দেশরক্ষা বাহিনী, পুলিশ বাহিনী ও অন্যান্য সব বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছি তারা তাদের মধ্যে যারা হত্যাকাণ্ড, গুম, খুন বা শারীরিক, মানসিক অত্যাচারে সরাসরি জড়িত তাদের চিহ্নিত করে বিচারের ব্যবস্থা করতে। যারা গুম হয়েছে, হত্যার শিকার হয়েছে, তাদের তালিকা প্রস্তুত করতে। তাদের পরিবার সমূহকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা আমার নেই। তাদের জীবনে শান্তি ফিরিয়ে আনতে আমরা প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবো। আমি সকল দেশরক্ষা বাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তাদের ওপর জনগণের সম্পূর্ণ আস্থা ফিরিয়ে আনতে সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করতে নির্দেশ দিয়েছি।১৫ বছরের দুর্নীতির শ্বেতপত্র
গত ১৫ বছরের দুর্নীতি, অর্থপাচার ও জনস্বার্থবিরোধী চুক্তিস্বাক্ষর, প্রকল্পের নামে লুটপাট ইত্যাদি তথ্য নিয়ে একটি শ্বেতপত্র প্রণয়নের জন্য ইতোমধ্যে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে, এই তথ্য জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, আমি বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত এবং দাতা সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছি এবং করে যাচ্ছি। ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থানের পর দেশ গঠনের জন্য সব প্রকার আর্থিক ও অন্যান্য সহযোগিতার জন্য তাদের অনুরোধ জানাচ্ছি। তারা এ ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। তাদের কাছে আমাদের প্রস্তাবসমূহ প্রণয়ন করে দ্রুত পাঠানোর ব্যবস্থা নিয়েছি। তাদেরও অনুরোধ জানিয়েছি তারা যেন পরিস্থিতির কারণে অতি দ্রুত অর্থ ছাড় করার ব্যবস্থা নেন। বলেছি, যে অবস্থার মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি তা যেমন একটি দুর্যোগপূর্ণ সময়, তেমনি এটি জাতির জীবনে মস্ত বড় সুযোগ। এই সুযোগকে যেন পূর্ণভাবে কাজে লাগাতে পারি সেজন্য তাদের সহযোগিতা চেয়েছি।
প্রবাসীদের অবদান
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এই গণ-অভ্যুত্থানে বিদেশে অবস্থানকারী বাংলাদেশিরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। জাতি তাদের অবদান বিশেষভাবে স্মরণ করবে। নতুন বাংলাদেশ গড়ার কাজে আমরা তাদের অংশগ্রহণ চাইবো।আমাদের একটি লক্ষ্য হবে বিদেশগামী এবং প্রত্যাবর্তনকারী প্রত্যেক প্রবাসী শ্রমিককে মর্যাদা ও সম্মানের সঙ্গে দেশে আসা এবং যাওয়া নিশ্চিত করা। সে ব্যাপারে শিগগিরই পদক্ষেপ নেওয়া হবে। বিদেশে অবস্থানরত সবার কাছে আমার আবেদন, তারা যেন তাদের উপার্জিত অর্থ অফিসিয়াল চ্যানেলে দেশে পাঠান। দেশের অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণে এই অর্থ বিশেষভাবে প্রয়োজন। কী কী ব্যবস্থা নিলে তাদের জন্য অফিসিয়াল চ্যানেলে অর্থ পাঠানো সহজ হবে, সেটা সম্বন্ধে আমরা তাদের পরামর্শ নেবো। ঘুষের মহাসমুদ্র ড. ইউনূস বলেন, সারা দেশ ঘুষের মহাসমুদ্রে নিমজ্জিত। কীভাবে ঘুষ থেকে আমরা মুক্ত হতে পারি তার জন্য আমাদের পরামর্শ দিন। শুধু এই কাজটা নিয়ে অগ্রসর হতে পারলেই আমি মনে করি দেশের জন্য এই সরকার একটা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছে বলে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এ ব্যাপারে আমি আমার সর্বশক্তি নিয়োজিত করবো। আমার কথা, আমাদের দায়িত্ব দেশের সব মানুষকে একটি পরিবারের বন্ধনে আবদ্ধ করা। মতভেদ থাকবে। বাগবিতণ্ডা হবে। কিন্তু আমরা ভাই-বোন, আমরা বাবা-মা। কারও শত্রু না। কাউকে তার মতের জন্য শত্রু মনে করবো না। কাউকে ধর্মের কারণে শত্রু মনে করবো না। কাউকে লিঙ্গের কারণে শত্রু মনে করবো না। আমরা সবাই সমান। কেউ কারও উপরে, কেউ কারও নিচে না। এই ধারণা আমরা জাতীয় জীবনে সর্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। যা চাওয়া তা লিখিতভাবে আমাদের দিয়ে যান
একটা বিশেষ ব্যাপারে আমরা আপনাদের সহযোগিতা চাচ্ছি। আমাদের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে প্রতিদিন সচিবালয়ে, আমার অফিসের আশপাশে, শহরের বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ করা হচ্ছে। গত ১৬ বছরের অনেক দুঃখ-কষ্ট আপনাদের জমা আছে। সেটা আমরা বুঝি। আমাদের যদি কাজ করতে না দেন তাহলে এই দুঃখ ঘোচানোর সকল পথ বন্ধ হয়ে থাকবে।
আপনাদের কাছে অনুরোধ, আমাদের কাজ করতে দিন। আপনাদের যা চাওয়া তা লিখিতভাবে আমাদের দিয়ে যান। আমরা আপনাদের বিপক্ষ দল নই। আইনসঙ্গতভাবে যা কিছু করার আছে আমরা অবশ্যই তা করবো। কিন্তু আমাদের ঘেরাও করে এই গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোকে আমাদের কাজে বাধা দেবেন না। সবাই মিলে তাদের বোঝান তারা যেন এসময়ে তাদের অভিযোগের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য আমাদের দৈনন্দিন গুরুত্বপূর্ণ কাজে বাধা না দেন।
নির্বাচন কবে হবে সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত
সুযোগ তারা আমাদের দিয়েছে তার মাধ্যমে আমাদের দেশকে পৃথিবীর একটি শ্রদ্ধেয়, সকল দিকে দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী দেশে পরিণত করতে আমরা শপথ নিয়েছি। সব শেষে আবারো আমাদের দেশের সকল মানুষ, শিশু, কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, বয়স্ক, বৃদ্ধ, নারী, পুরুষ সবার কাছে দোয়া চাইছি যেন আমরা আমাদের সকলের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সফল হই। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন, আমাদের সবার মঙ্গল করুন।
নিশ্চয়ই প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুসের ভাষণ জাতির আশার আলোর প্রতিফলন। আমরা সবাই কামনা করি যে, এই ভাষণটি আজীবন বাঙালি জাতির মনে থাকবে, যদি তা বাস্তবে কার্যকর হয়। আমি বিশ্বাস করি, তিনি কথায় নয়—কাজে বিশ্বাসী।
লেখক: সাংবাদিক, গবেষক, টেলিভিশন উপস্থাপক।
Leave a Reply