পটিয়া চট্টগ্রামের একটি সমৃদ্ধ জনপদ। শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সব দিক থেকে এ অঞ্চল অগ্রগামী। তবে এখনো অনেকাংশে উন্নয়ন হয়নি। দেশের সব মহকুমাকে জেলা হিসেবে ঘোষণা করা হলেও সাবেক মহকুমা পটিয়াকে করা হয়নি। ফলে এটি উপজেলাতেই থেকে গেল। সবার উন্নতি হলেও পটিয়ার কেন হয়নি? পটিয়াকে ১৯৭৫ সালে জেলা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সব অবকাঠামো থাকার পরও এই ঘোষণা এখনো বাস্তবায়িত না হওয়ায় পটিয়ার কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হয়নি। বর্তমানে বহুমুখী সংকটের মধ্যে চলছে পটিয়া। পটিয়ার কিছু ইউনিয়ন নিয়ে আলাদা উপজেলা করা হয়েছে । এভাবে দিন দিন ক্ষয়িষ্ণুর দিকে যাচ্ছে পটিয়া। পটিয়ার প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলন করা হলে এই অঞ্চলের গ্যাস–সংকটের সমাধান হবে। শ্রীমতী খালে রাবার ড্যাম নির্মাণ করা হলে কৃষির সমস্যা অনেকটা দূর হবে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পটিয়া অংশ অত্যন্ত সরু। ফলে পটিয়া পৌর এলাকায় নিয়মিত যানজট হয়। দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রথম আদালত স্থাপন করা হয় পটিয়ায়। ১৮৮২ সালে নির্মিত পটিয়ার মুনসেফ কোর্টের অবস্থা বর্তমানে খুবই নাজুক। বৃষ্টির পানিতে আদালতের মূল্যবান নথি নষ্ট হচ্ছে। উইপোকার উপদ্রবও আছে। ১৯৮৫ সালে এটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। ছয়তলা ভিতযুক্ত তিনতলা ভবন নির্মাণের জন্য ২০ কোটি টাকার একটি প্রস্তাব বাস্তবায়নে আইন মন্ত্রণালয় অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়। গণপূর্ত বিভাগ ১০ কোটি টাকার মধ্যে নকশা জমা দিতে বলে। পরে সংশোধন করে প্রকল্প পাঠানো হলেও আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। পটিয়ার সাতটি আদালতের কয়েকটিতে ৩০ বছর ধরে বিচারক ছিলেন না। এখানে কর্মকর্তার সংকট আছে। আবাসন সংকটও প্রকট। এসব সংকটের কারণে বিচারকেরা তিন বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই বদলি হয়ে চলে যান। এই সংকট নিরসনের জন্য জাজেস কমপ্লেক্স নির্মাণ করতে হবে। বিচারকদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। সম্প্রতি বিভিন্ন কারণে পটিয়ায় খাবার পানির সংকট তীব্র হয়ে উঠেছে। তিন শতাধিক নলকূপের মধ্যে পানি ওঠে না। পটিয়ায় পরিবেশ বিপর্যয় হচ্ছে। বিভিন্ন শিল্প-কারখানার বর্জ্য খালগুলোতে নিক্ষেপ করা হয়। খালের মাছ মরে যাচ্ছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে বর্জ্য সরাসরি জমিতে ফেলা হয়। এতে সেচ ব্যবস্থা ও ধানের চারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে পটিয়ার আবাসন ব্যবস্থা। এই কারণে এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। এ ছাড়া এলাকায় মাদক ব্যবসার বিস্তার ঘটছে। মাঝেমধ্যে পুলিশ গ্রেপ্তার করলেও কিছু দিনের মধ্যেই জামিন নিয়ে বেরিয়ে আসেন মাদক ব্যবসায়ীরা। <span;>কয়েক মাস ধরে পটিয়ায় নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনকে বলেও এর প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। এসব ঘটনায় নির্যাতিত মহিলাদেরকে অর্থের অভাবে হাসপাতালে ভর্তি করা যাচ্ছে না। এমনিতেই তাঁদের মধ্যে সচেতনতা ও শিক্ষার অভাব রয়েছে। নির্যাতিত নারীদের স্বনির্ভর করে তুলতে হবে। তাঁদের হাতে-কলমে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। এতক্ষণ ধরে পটিয়ার বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এখন এই অঞ্চলের বেশ কিছু সম্ভাবনার কথা তুলে ধরতে চাই। শিক্ষার হার অনেক এগিয়েছে। মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে। এখানে মৎস্য, দুগ্ধ, লবণশিল্প গড়ে উঠেছে। পরিকল্পিতভাবে কাজ করলে পর্যটনশিল্প বিকাশের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। ক্রীড়াঙ্গনের বিভিন্ন শাখায় বিশেষ করে ফুটবল, ক্রিকেট ও অ্যাথলেটিকসে পটিয়ার খেলোয়াড়রা ভালো পারফরম্যান্স করছেন। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন এলাকার তুলনায় এখানে রাজনৈতিক সহাবস্থানের পরিবেশ চমৎকার। রাজনৈতিক হানাহানি নেই। সহিংসতাও খুব একটা হয় না। সড়ক ও বিদ্যালয় অবকাঠামোর ব্যপক উন্নতি হয়েছে তবে এখানে উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ কম। পর্যাপ্ত কলেজ নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক স্বল্পতা রয়েছে। লোডশেডিংয়ের কারণে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি পোহাতে হয়। পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা বিরাট সমস্যা। এটি আরও অনেক উন্নত করতে হবে। পটিয়ায় বিসিক শিল্প এলাকা রয়েছে। ইন্দ্রপুল এলাকায় লবণের কারখানার রয়েছে। আন্তর্জাতিক মানের জাহাজ তৈরি হচ্ছে এখানে। পটিয়াকে জেলা ঘোষণার সিদ্ধান্ত পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হলে এখানকার চেহারা পাল্টে যেত। পটিয়ার অর্থনৈতিক সম্ভাবনার জন্য একে অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘোষণা করা যায়। পটিয়ায় প্রায় ৫০০টি দুগ্ধ খামার রয়েছে। কিন্তু প্রক্রিয়াজাতকরণ জটিলতায় সারা দেশে দুধ পরিবহন করতে পারছেন না। একটি দুগ্ধ শীতলীকরণ কারখানা রয়েছে। ওই কারখানায় তিন দিন দুধ রাখা যায়। হরতাল-অবরোধের সময় তাদের ব্যবসা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখানে একটি পূর্ণাঙ্গ শীতলীকরণ কারখানা চালু করতে হবে। পটিয়ার ছয় লাখ লোকের জন্য মাত্র ৫০শয্যার একটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে। হাসপাতালের অবকাঠামোর অভাব রয়েছে। খাবার পানির সংকট রয়েছে হাসপাতালে। দর্শনার্থীদের কারণে হাসপাতালের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। এই অবস্থায় হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবার মান কীভাবে উন্নত করা যাবে? তবে আশার কথা হচ্ছে বর্তমানে এই হাসপাতালে চিকিৎসক সংকট নেই। সম্প্রতি পটিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কে হাসপাতাল ঘোষণা করা হয়। এদিকে পটিয়ার দুটি ফিডার লাইনের সংযোগ হাসপাতালে দেওয়া হলে আর জেনারেটর চালাতে হবে না। জেনারেটর থাকলেও তার জন্য জ্বালানি তেলের বরাদ্দ নেই। অ্যাম্বুলেন্স ও বিভিন্ন তহবিল থেকে জ্বালানি তেলের খরচ মেটানো হয়। হাসপাতালের জন্য নতুন অ্যাম্বুলেন্স প্রয়োজন। ডিজিটাল এক্স-রে যন্ত্র আছে কিন্তু এটি চালানোর জন্য লোকবল নেই। অবেদনবিদের অভাবে পটিয়ায় এখন রাতের বেলায় অস্ত্রোপচার করা সম্ভব হয় না। দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রথম স্বাস্থ্যকেন্দ্র পটিয়া ইউনিয়ন সাব-সেন্টারের ভূমি জেলা পরিষদ তাদের নিজস্ব সম্পত্তি বলে দাবি করছে। এই জায়গায় ট্রমা সেন্টার কিংবা মাতৃসদন হাসপাতাল চালু করা যেতে পারে। পটিয়ার অনেক ইউনিয়নে শিক্ষার মান খারাপ হয়েছে। তাই উপজেলা সদরের বিদ্যালয়ে ভর্তির চাপ বাড়ছে। এ ছাড়া ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে চিকিৎসকদের উপস্থিতি সন্তোষজনক নয়। পটিয়ার প্রত্যেকটি ইউনিয়নে মাদকের বিস্তার ঘটেছে। ইয়াবা পাচারে রুট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে পটিয়াকে। ইউনিয়নগুলোতে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়েছে। এলাকার ভালো মানের পাঠাগার নেই।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে প্রায় ৫০ বিপ্লবীর জন্ম হলেও তাঁদের তথ্য-উপাত্ত কেউ দিতে পারে না। মহান মুক্তিযুদ্ধে পটিয়া থেকে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা নেই। পটিয়ার সমস্যা সমাধানে সবাইকে ঐক্যমতের ভিত্তিতে কাজ করতে হবে। ঐতিহ্য সমৃদ্ধ এই অঞ্চলকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাতে হলে এর বিকল্প নেই। পটিয়ায় একসময় সুশাসন ছিল না। পুরো এলাকা বিধ্বস্ত ছিল। এখন এলাকার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সচেতন মানুষ এগিয়ে এসেছেন। রাজনৈতিক হানাহানি বন্ধ হয়েছে। দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাত উপজেলার মানুষ একমত হলে জেলা হবে। কিছু লোকের উগ্র ও একগুঁয়ে চিন্তাভাবনার কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। এই জেলার নাম হতে পারে দক্ষিণ চট্টগ্রাম। এর সদর হবে পটিয়া। দলমত-নির্বিশেষে সবাই চেষ্টা করলে পটিয়ার হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। পটিয়ায় কৃষি ও শিল্পের বিকাশ ঘটেছে। এখানে ১৪ হাজার ৫০০ হেক্টর চাষাবাদযোগ্য জমি রয়েছে। ৪০টি লবণের কারখানা রয়েছে। দুগ্ধ খামার রয়েছে পাঁচ শতাধিক। মুরগির খামার রয়েছে ৪৬৩টি। এই অঞ্চলের মাছের পোনা সারা দেশে যায়। মাছের একটি হাট গড়ে উঠেছে। সেখানে প্রচুর বেচাকেনা হয়। কৃষি খাতের এই বিকাশের সুফল পাচ্ছে সবাই। উপজেলায় স্লুইস গেট ও কালভার্টগুলো নির্মাণ করা হয়েছে ১৯৫৮ সালের আগে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। ফলে ছয় ফুট উচ্চতার স্লুইস গেটগুলো কার্যকর হচ্ছে না। পটিয়ার শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর কারণে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রায় প্রত্যেকটিতে ইটিপি রয়েছে। কিন্তু এসব ব্যবহার করা হয় না। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানের সময় মালিকপক্ষ তা চালু করে, অন্য সময় বন্ধ থাকে। এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ইটিপি কীভাবে নিয়মিত ব্যবহার করা যায়, তা চেষ্টা করতে হবে।
বিসিক শিল্প এলাকায় প্লটগুলো বরাদ্দ নিয়ে খালি রাখায় তা বাতিল করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে বরাদ্দপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নোটিশ দেওয়া হয়েছে। কিছু প্লট বাতিল করা হয়েছে। এসব প্লট নতুন করে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। উপজেলার অবকাঠামো থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে পটিয়া। মহাসড়ক পটিয়া পৌরসভা এলাকায় চার লেন না হোক, অন্তত দুই লেন হলেও তা হবে পটিয়ার মানুষদের জন্য আশীর্বাদ। উপজেলা পরিষদের আয়ের মূল উৎস স্থানীয় হাটবাজারের ইজারা থেকে প্রাপ্ত অর্থ। যানজট নিরসনের জন্য এসব হাট অন্যত্র সরানো প্রয়োজন।প্রাচীন জনপদ হিসেবে পটিয়া তার ঐতিহ্য কতটুকু ধরে রাখতে পেরেছে তা এখন প্রশ্নের বিষয়।পটিয়াকে জেলা ঘোষণার সম্ভাবনা বাড়ছে। শুধু ভৌগোলিক অবস্থান দেখে জেলা ঘোষণা করা হয় না। এর জন্য রাজনৈতিক ঐতিহ্য, কৃষি, ইতিহাস ও শিল্প-ঐতিহ্য দেখা হয়। পটিয়ার মানুষ তাঁদের দায়িত্ব পালন করেছে। তবে পটিয়ার সঙ্গে অবিচার করেছে রাজনীতি, রাষ্ট্র ও প্রশাসন। পটিয়া পৌরসভা হয়েছে ১৯৯০ সালে। পৌরসভার আয়তন মাত্র ১০ দশমিক ৩ বর্গকিলোমিটার। এই আয়তনের মধ্যে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার সীমাবদ্ধতা আছে। এখনো অনেক অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়নি।নাগরিকদের শতভাগ সেবা দিতে গেলে পৌরসভার আয়তন বর্ধিত করতে হবে। পৌরসভার আয়তন ২৫ বর্গকিলোমিটার করার প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে অনেক দিন ধরে। সবাই বলছে। কিন্তু কাজ হয়নি। সমস্যা থাকবে এগুলোর সমাধানও রয়েছে। এক্ষেত্রে সবার সহযোগিতা একান্ত জরুরি। ভালকাজের যেমন সুনাম করতে কৃপণতা করবেননা তেমনি খারাপ কাজেরও গঠনমূলক সমালোচনা করতে হবে এটাই একজন নাগরিক হিসেবে দায়িত্ব ও কর্তব্য। পটিয়ার সমস্যার চেয়ে সম্ভাবনা প্রচুর। আশাকরি সকল সমস্যার উত্তরণ হবে। আলোকিত পটিয়া সগৌরবে প্রতিষ্ঠিত হবে।
লেখকঃ কবি ও সাংবাদিক
Leave a Reply