নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
শরীয়তপুর থেকে সাবেক স্ত্রীকে নিয়ে এসে স্বামী নিজেই তার পরিচিত কাজী দিয়ে কাবিন ও হলফনামা সৃজন করে বাকলিয়ায় একটি বাসা ভাড়া নিয়ে পুনরায় সংসার শুরু করেন ইসলামী ব্যাংক কর্মকর্তা মোঃ রাশেদ। কিছুদিন ভাড়া বাসায় থাকার পর যৌতুক দাবি করে না পেয়ে স্ত্রীকে মারধর করে ঘুমন্ত স্ত্রীর স্বর্ণালংকার নিয়ে পালিয়ে যান রাশেদ। নিজেই তার লোকজন দ্বারা কাবিন ও হলফনামা সৃজন করে ওই নারীকে স্ত্রী হিসেবে অস্বীকার করার প্রতিবাদ ও ন্যায় বিচারের দাবিতে চট্টগ্রামের চাক্তাইয়ে অবস্থিত ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড আসাদগঞ্জ উপশাখার সামনে অনশনে বসেছেন ভুক্তভোগী ওই নারী। সরেজমিনে, রবিবার (২৮ জুলাই) ব্যাংকের সামনে ওই নারীকে বসে থাকতে দেখা যায়। রাশেদ চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার ভাটিখাইন গ্রামের মৃত হাফেজ আহম্মদের ছেলে। এছাড়াও গত ১৬ জুলাই প্রথম অনশনে বসে ওই নারী। সেদিন অনশনে বসার খবর পেয়ে কোতোয়ালী থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে ওই নারীকে বুঝিয়ে তার বাবার বাড়িতে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করে ব্যর্থ হয়। এসময় ওই নারী উপস্থিত পুলিশ সদস্যদের সামনে বিষপানের চেষ্টা করলেও তা উদ্ধারে চেষ্টা করেনি পুলিশ। পরে ওই নারী ব্যাংকের সামনে বিষপান করে। এসময় উপস্থিত লোকজন তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে বাসায় ফিরে রবিবার পুনরায় দ্বিতীয় দফার অনশনে বসেন তিনি।
ভুক্তভোগী নিপা আক্তার বলেন, প্রথম কাবিনের দেনমোহরের টাকা জালিয়াতির পর কয়েক দফায় রাশেদ কাবিন জালিয়াতি করেছে। প্রথম বিয়ের দেনমোহর না পেয়েও পেয়েছি- এমন প্রতারণার পর দ্বিতীয় বিয়ের সময়ও রাশেদ-মনির ও জসিম আমার সাথে কাবিন নিয়ে প্রতারণা করেছে। দ্বিতীয় বিয়ের কাবিন এখনো আমি পাইনি। এমনকি তার বন্ধু মনিরের পরামর্শে আমার দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিয়ের সময় আমার পক্ষের কোনো শিক্ষিত লোক থাকতে দেয়নি তারা। দেনমোহর জালিয়াতির প্রথম পর্যায়ে যেসকল শিক্ষিত ব্যক্তি আমাকে সহযোগিতা করতে চেয়েছিল ভবিষ্যতে যেকোন কাজে তাদের সহযোগিতা না নিতেও বাধ্য করেন আমাকে। ফলে, সকল মামলা প্রত্যাহার করে আপোষ মীমাংসার দিন তাদের পাওয়া যায়নি। একতরফাভাবে সকলের আসিফের লোক ছিল। এ সুযোগে জাল জালিয়াতি করেছে রাশেদ ও তার লোকজন। দ্বিতীয় বিয়ের সময় ব্ল্যাংক স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর রাখে তারা। পরবর্তীতে এটিকে খোলা তালাক হিসেবে প্রচার করে। আমি আমার শিশু সন্তানের কথা ভেবে শুধুমাত্র সংসার টেকাতে তাদের শর্ত মতো দেনমোহরের পাঁচ লাখ টাকা না পেয়েও এক লাখ টাকার কাবিন তৈরিতে সম্মত হয়েছি। তারা এতেও প্রতারণা করল।
তিনি আরও বলেন, আমি তার বিরুদ্ধে একটি ন্যায্য মামলা দিলে, সে আমার বিরুদ্ধে এক হালি মিথ্যা মামলা দেয়- যেন আমি মামলা তুলে নেই। এদিকে মিথ্যা মামলাগুলো পরিচালনা করতে তার ব্যাংকের টাকা আছে, বেকার এক গৃহিণী। একটি ন্যায্য মামলা পরিচালনা করতেই যেখানে টাকা নেই, সেখানে এতগুলো মিথ্যা মামলা পরিচালনা করতে টাকা পাবো কোথায়? তাই আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছি। আমি চাই রাষ্ট্র আমাকে মেরে ফেলুক, নয়তো পাশে দাঁড়াক।
তবে অনুসন্ধান করে নিপা আক্তারের বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া গেছে। নিপা আক্তার রাশেদের স্বাক্ষর জালিয়াতির যে অভিযোগ এনেছেন, বিভিন্ন নথি পর্যালোচনা করে এক এক নথিতে একেক রকম স্বাক্ষর পাওয়া গিয়েছে। রাশেদের কাবিননামা ও তালাক নোটিশের স্বাক্ষরে রয়েছে যথেষ্ট ভিন্নতা। সত্যতা পাওয়া গেছে, মনির ও জসিম নামের দুই ব্যক্তির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগও। ৪৫ মিনিটের এক অডিও ক্লিপে শোনা যায়, আইনজীবী পরিচয় দেওয়া মনির ও জসিম ভুক্তভোগী নিপাকে সংসার করার শর্তে বেশ কয়েকটি শর্ত জুড়ে দেয়। যার অন্যতম শর্ত ছিল, দেনমোহরের ৫ লাখ টাকা না পেয়েও পেয়েছে মর্মে স্বীকার করা। পুনরায় এক লক্ষ টাকার কাবিন তৈরি করা ও মেয়ের মোবাইল ফোন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। পরে মেয়ের পক্ষে শিক্ষিত ব্যক্তিদের আনতে না পারার নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আর কাবিনও করেনি। সেই সাথে নেয়া হয় দুইটি ব্ল্যাংক স্ট্যাম্পে সাইন। কুটকৌশলের অংশ হিসেবে ৫ লক্ষ টাকা না দিয়েও ওই নারীকে দিয়ে স্বাক্ষর করিয়ে ভবিষ্যতে নিরাপদ থাকতে তা ভিডিও করে নেন। মেয়ের আগের স্বামীর দেহমোহরের টাকা প্রচার করে এটি নিজের বলেও দাবি করেন তিনি। অথচ আগের স্বামীর সকল টাকা রাশেদ নিজেই ভোগ করে এবং ভালোবেসে এই নারীকে বিয়ে করেন। নিজেই ছবি তুলে আগের বিয়ের কথা জানে না বলে প্রচার করে।
জানা যায়, রাশেদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর চিঠি পাঠিয়েছেন ভুক্তভোগী নিপা। উল্লেখ্য, মোঃ রাশেদ ২০২১ সালে নিপা আক্তারকে ভালোবেসে বিয়ে করেন এবং এ পরিবারে তাদের একটি পুত্র সন্তান রয়েছে। বিয়ের পর সাময়িক সুখে থাকলেও কিছুদিন পরই যৌতুকের দাবিতে শুরু হয় স্ত্রীর উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। ২০২২ সালের ২৭ এপ্রিল অভিযুক্ত রাশেদ তার স্ত্রী নিপার আক্তারের নিকট ৫০ হাজার টাকা ও একটি মোবাইল ফোন দাবি করে। মোবাইল ফোন কিনে দিলেও টাকা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় কাউকে না জানিয়ে শরীয়তপুর থেকে চট্টগ্রাম চলে আসে রাশেদ। এরপর থেকে তালাক নোটিশ পাঠায়, যৌতুক নিয়ে নোটিশ প্রত্যাহার করে। আবার নোটিশ পাঠায়, আবার প্রত্যাহার করে। নোটিশ—প্রত্যাহার, নোটিশ—প্রত্যাহারের ট্রেন চলতে থাকলে হয়রানির চির মুক্তির জন্য ২০২২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর আদালতে মামলা করতে বাধ্য হন স্ত্রী নিপা আক্তার। তার স্ত্রী যেকোন শর্তে সংসার করতে আগ্রহী হওয়ায় পাঁচ লাখ টাকার দেনমোহর না পেয়েও পেয়েছে ও মামলা তোলার শর্তে বাধ্য করেন স্বামীর বন্ধু মনির নামের এক ব্যক্তি (ভিডিও/অডিও ক্লিপ রয়েছে)। পরে তিনিই আবার এক লক্ষ টাকা দেনমোহরে কাবিননামা বিহীন জাল জালিয়াতি করে বিয়ে করান। কয়েক মাস পর দেওয়া হয় পুনরায় তালাক। জানা যায়, দেনমোহর থেকে বারবার প্রতারিত হওয়া নিপা শরীয়তপুর জেলা লিগ্যাল এইড অফিসে শিশুর ভরণপোষণের জন্য আবেদন করলে লিগ্যাল এইড অফিসার প্রতিমাসের জন্য ৫০০০ টাকা ধার্য করে দেন। যা প্রতিবছর ১০% হারে বৃদ্ধি পাবে। এক শিশুর ভরণপোষণের জন্য প্রতি মাসে এ টাকা দিতে পারলে সংসারই করা যায় উল্লেখ করে রাশেদ পুনরায় ফেব্রুয়ারির ১০ তারিখ ১২ লক্ষ টাকা মোহরানা ধার্য্যে আরেকটি কাবিননামা সম্পাদনা করেন তার বন্ধু মনিরকে দিয়ে এবং বাসা ভাড়া নিয়ে নগরীর কালামিয়া বাজার দু’তলা মসজিদের পাশে আব্দুল খালেকের বাড়িতে একসাথে থাকতে শুরু করে। ৭ মে আবারো ২ লাখ টাকা যৌতুক দাবি করেন রাশেদ। যৌতুক না পেয়ে স্ত্রীকে মারধর করে ঘুমন্ত স্ত্রীর স্বর্ণালংকার নিয়ে বের হয়ে যান তিনি। এ বিষয়ে থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করতে গেলে থানা আদালতে মামলা দায়ের করার পরামর্শ দেন। পরে এই নারী বাধ্য হয়ে আদালতে যান। জানা যায়, রাশেদ তার বন্ধু মনিরের সহযোগিতায় কাবিন সম্পাদনা করে উল্টো তিনি নিজেই কাবিন জালিয়াতির মামলা করেন। এবিষয়ে রাশেদ ও তার অজ্ঞাত আইনজীবীর বিরুদ্ধে হুমকির অভিযোগ এনে বাসার বাড়িওয়ালী বলেন, তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনে সশরীর উপস্থিত হয়ে বাসাটি ভাড়া নিয়েছে। পরের দিন রাশেদ নিজেই বাসাটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে। এ সময় রাশেদ তার জাতীয় পরিচয় পত্র ও কাবিননামার ফটোকপি জমা দেয়। তখন তারা স্বামী-স্ত্রী একে অপরের পাশে ছিল।
তরণীর বিষপানের ঘটনায় কোতোয়ালী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসির) মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি জানান, শুনেছি এক তরুণী অনশনে বসেছিল কিন্তু বিষ পানের তথ্য জানা নেই। অথচ ওই নারী বিষপান করলে উপস্থিত পুলিশ সদস্যদের একজন এসআই রেজাউলকে বিষয়টি অবগত করে এম্বুলেন্স পাঠানোর অনুরোধ করলে তিনি পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ বাবলুর সাথে যোগাযোগ করতে বলে লাইনটি কেটে দেন। একাধিকবার কল করেও পাওয়া যায়নি উপস্থিত পুলিশ সদস্যদের অন্যতম এসআই বাবলুকে। এদিকে বিষপানের ঘটনাটি নিশ্চিত করে এম্বুলেন্সের সহযোগিতা চেয়ে এক সাংবাদিক ফোন করেন কোতোয়ালী থানার অফিসার ইনচার্জকে। তখন ওসি এম্বুলেন্স পাঠিয়ে সহযোগিতার আশ্বাস দিলেও পরের দিন অন্য সাংবাদিকদের জানান, বিষপানের ঘটনা তার জানা নেই।
Leave a Reply