“ঈদে মিলাদুন্নবী (দঃ) হোক বিশ্ব মানবতার মুক্তির সোপান” মাওলানা মুহাম্মদ বোরহান উদদীন
সময়
বৃহস্পতিবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
৭০
পঠিত
বর্ষ পরিক্রমায় পবিত্র মাহে রবিউল আউয়াল আবারো ঘুরে এলো আমাদের দ্বারে। তাতেই বিশ্ব জাহানের নবী প্রেমিকদের অন্তর রসূল (দ.)’র প্রেম ও ভালবাসা প্রবলভাবে জাগরিত হয়। বর্তমান নাজুক এই সময়ে যখন বিশ্ব জুড়ে দুর্বলের ওপর সবলের, মুসলমানদের ওপর ইসলাম বিদ্বেষী ইহুদী-খ্রিষ্টান চক্র যখন ফিলিস্তিনে রক্তের হোলি খেলায় মেতেছে, মায়ানমার, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়া, মিশর, ইয়ামেনের মত ইসলামী রাষ্ট্রের উপর চরম জুলুম নিপীড়ন বিশেষ করে মায়নমারের নিরীহ অবুঝ শিশু ও মুসলমানের উপর বর্বর গণহত্যায় রোহিঙ্গা মুসলমানরা দেশ ছাড়া হয়েছে , ভারত ও চীন সরকারের পৃষ্টপোষকতায় তাদের বিভিন্ন প্রদেশে মুসলমানদের ওপর নির্মম হত্যা, অত্যচার ও দেশান্তরি করেছে এমন বাকরুদ্ধ সময়ে বছর ঘুরে শান্তি ও মুক্তির সওগাত জানান দেয় মহানবী (দ,)’র মিলাদ তথা শুভাগমন স্মৃতি বিজড়িত পবিত্র মাহে রবিউল আউয়াল।
যখন মানবতার প্রতিটি অঙ্গন বর্বরতা ও ঘৃণ্যতায় বিপর্যস্থ হয়ে কলুষিত ছিল, ঠিক তখনই ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই রবিউল আউয়াল সুবহে সাদিক সময়ে মক্কার বুকে বাবা আবদুল্লাহ (রা.) ও মা আমেনা (রা.)’র কুলে অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগে মুক্তির শাশ্বত বার্তা নিয়ে প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (দ.) ধারার এ বুকে আর্বিভূত হন। যাঁর নূরের স্পর্শে বিশ্ব জাহান হয়ে ওঠে উদ্ভাসিত, আলোকিত ও মহিমান্বিত। কবি গোলাম মোস্তফার ভাষায় –
তোমারি নূরের আলোকে
জাগরণ এল ভুলোকে,
গাহিয়া উঠিল বুলবুল/
হাসিল কুসুম পুলকে।।
এই যেন তমসার বুকে চাঁদের উদয়’। দীর্ঘ সাধনা, ধৈর্য্য ও ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে তিনি দুর্ধর্ষ আরব জাতিকে ইসলামের পতাকাতলে সমবেত করেন। বর্বর ও অসভ্য জাতিকে সু-সভ্যরূপে গড়ে তুলেন। অশান্ত পৃথিবীকে দেখান শান্তি ও কল্যাণের সুপথ। অধিকার বঞ্চিত মজলুম মানুষ তার নূরানী ছোয়ায় ফিরে পায় আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার। কন্যাশিশু ও নারী ফিরে পায় তার যথাযথ মানবিক, ধর্মীয় ও সামাজিক মর্যাদা। সর্বস্থরের মানুষের মাঝে সুন্দরভাবে জীবনধারনের সাহস ও আত্ম-বিশ্বাস ফিরে আসে তাঁরই ওসিলায়। কবির ভাষায় – তোমারি নূরের আলোকে,
জাগরণ এল ভুলোকে/
গাহিয়া উঠিল বুলবুল,
হাসিল কুসুম পুলকে।।
মানবতার মূর্তপ্রতীক মহানবী (দ.)’র আগমনে মানবজাতি রহমত ও কল্যাণময় পথের পরিপূর্ণ দিক-নির্দেশনা, মানবিক মূল্যবোধ ও মর্যাদার গভীরতম চেতনা লাভ করে ধন্য হয়। তাঁর মাধ্যমেই ইসলাম পরিপূর্ণতা লাভ করে।
ফলে তাঁর পৃথিবীতে শুভাগমনের দিনটির চেয়ে সবচেয়ে বেশি আনন্দের দিন মুসলমান তথা পৃথিবীর জন্য আর কি হতে পারে? জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম কতইনা সুন্দর করে বলেছেন- “ত্রিভূবনের প্রিয় মোহাম্মদ এলরে দুনিয়ায়/আয়রে সাগর আকাশ বাতাস দেখবি যদি আয়”!
তাই মুমিন হৃদয় তাঁর শুভাগমনের দিনে আনন্দোৎসব, মৌন মিছিল করে, বর্ণাঢ্য শুভাযাত্রা বা জশনে জুলুস বের করে, অযুত-নিযুত কোটি যিকির-আজগার, দরুদ-সালাম ও দান খয়রাত করে যা অত্যন্ত সওয়াবের কাজ।
এ প্রসঙ্গে স্বয়ং রাব্বুল আলামীন এরশাদ করেছেন, “হে মাহবুব! আপনি বলে দিন তারা (বান্দা) যখন তাদের আল্লাহর পক্ষ হতে কোন নেয়ামত/অনুগ্রহ লাভ করে তখন তারা যেন তার জন্য খুশি উদযাপন করে। (সুরা ইউনুস-৫৮ নং আয়াত)
তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে নিআমত ও অনুগ্রহ লাভে খুশি হয়। আর নিশ্চয় আল্লাহ মুমিনদের প্রতিদান নষ্ট করেন না।(সুরা আলে ইমরান,১৭১ নং আয়াত)
অপর আয়াতে ইরশাদ করেছেন- আমি আপনার খ্যাতিকে সু-উচ্চ মর্যাদা দান করেছি। (সুরা ইনশিরাহ) তাইতো আল্লাহ ও তার ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি দরুদ ও সালাম পেশ করে, অতএব হে ঈমানদারগণ তোমরাও আদবের সাথে আমার নবীর উপর দরুদ ও সালাম পেশ কর। (সূরা আহযাব,আল-কুরআন)
তাই মহান আল্লাহ প্রিয় হাবীবের স্মরণে শুধু এই দিনটিতে নয় বরং দুনিয়ার প্রতিটি প্রান্তে অযুত কন্ঠে জিকির-আজকার হচ্ছে প্রতিটি অণুক্ষণে। যেমন পারস্যের জগৎ বিখ্যাত কবি শেখ সাদি রাহমাতুল্লাহি আলাইহির বলেন- বালাগাল ওলা বে-কামালিহি, কাশাফাদ্দোজা বে জামালিহি, হাসনাত জা’মিও খেসালিহি সাল্লু আলাই ওয়ালিহি। এর ভাবার্থ হচ্ছে-
‘সাধনায় যিনি সুউচ্চ মর্যাদায় পূর্ণতায় পৌঁছেছেন, যার সৌন্দর্যের ছটায় বিতাড়িত হয়েছে সমস্ত আঁধার, সব সচ্চরিত্রের সম্মিলন ঘটেছে যার মাঝে,
তবে আসুন দরুদ ও সালাম জানাই তাঁর ও তাঁর বংশধরদের প্রতি।’
ইমাম আ’লা হযরত (রাহঃ) বলেছেন- মোস্তফা জানে রহমত পেলাহ কো-সালাম/ ইয়া নবী সালাম আলাইকা-হে নবী আপনার প্রতি লাখো দরুদ ও সালাম ইত্যাদিসহ হাজারো কোটি কবিতার ভাষায়।
ফরাসী ঐতিহাসিক দার্শনিক লা মার্টিনের অকপটে স্বীকার করেছেন-মহানবী (দ.) দার্শনিক, বাগ্মী, বাণীবাহক, আইনপ্রণেতা, যুদ্ধা, সর্বমতবাদের উপর বিজয়ী, যুক্তিপূর্ণ বিশ্বাসের এক মূর্তিহীন ধর্মীয় মতবাদের প্রর্বতক দুনিয়ার বুকে কুড়িটি পার্থিব সাম্রাজ্যসহ একটি একক আধ্যাত্মিক, মহান আল্লাহর মনোনীত মতবাদ ইসলাম সম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন।
তিনি আরো বলেছেন-মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব পরিমাপে দুনিয়াতে বিশ্বনবী (দ.)’র চাইতে আর কোন শ্রেষ্ঠতর ব্যক্তি আছেন কি? নিশ্চয় তিনি অতুলনীয় ও তুলনাহীন।আল্লামা ইবনে হিশাম বলেন-মক্কা বিজয়ের দিনও তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়াবনত, দরদী ও সহনশীল। আর আল্লাহ তায়ালা মহানবী (দ.) এর মাধ্যমে ইসলামকে পরিপূর্ণতায় রূপ দান করেছেন। কবি গোলাম মোস্তফা’র কবিতার ভাষায় বলেন-
তুমি যে নূরের নবী,
নিখিলের ধ্যানের ছবি,
তুমি না এলে দুনিয়ায়,
আঁধারে ডুবিত সবি।।
বস্তুত তাঁর মহান বর্ণাঢ্য পুতঃপবিত্র জীবন আদর্শ অনুসরণ ও অনুকরণের মাধ্যমে বর্তমান নাজুক বিশ্বে শান্তি, সাম্য, ন্যায় বিচার, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারি।
ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.)’র এই পবিত্র ক্ষণে আমরা তাঁর জীবনার্দশ অনুসরণের মাধ্যমে পৃথিবীতে শেষ দিন পর্যন্ত মানুষকে শান্তি, ন্যায় ও কল্যাণের পথ দেখাতে পারি। মহামানব বিশ্বনবী (দ.)’র জন্ম ও ওফাত শরীফের স্মৃতি বিজড়িত পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) হোক মানবতার কল্যাণের শিক্ষাগ্রহণের এক উৎজ্বলতম ক্ষণ। নিশ্চয়ই তাঁর মহান জীবন আর্দশের মধ্যে রয়েছে আমাদের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ জীবনাদর্শ ও শিক্ষা।
লেখক-প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ:
মুদাররিস- জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া মহিলা কামিল মাদরাসা, ষোলশহর, চট্টগ্রাম।
খতিব: মসজিদে রহমানিয়া গাউসিয়া,বায়েজিদ, চট্টগ্রাম।
Leave a Reply