
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
২৫ আগস্ট ২০২৪-এর ছাত্র-জনতার বিপ্লবের পর থেকে শ্যামনগর উপজেলায় সাংবাদিকতা পেশার মর্যাদা যেন একদম তলানিতে। মাত্র একটি উপজেলায় এখন ‘সাংবাদিক’ পরিচয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ৩০০ জনেরও বেশি মানুষ—যাদের অধিকাংশই পেশাটিকে ব্যবহার করছেন ব্যক্তিগত প্রভাব, চাঁদাবাজি, হুমকি আর দাপট দেখানোর ঢাল হিসেবে।
স্থানীয় হকার, মুদি দোকানদার, তরকারিওয়ালা, রাজমিস্ত্রি, ড্রাইভার, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, এমনকি মাদক ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের দালাল, সবাই এখন পাঁচ হাজার টাকার কম-বেশি বিনিময়ে ভুয়া সনদ দিয়ে অনলাইন পোর্টাল কিংবা আঞ্চলিক ও জাতীয় পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করছেন ‘প্রেস কার্ড’। সেই কার্ডই তাদের প্রধান অস্ত্র: পুলিশি ঝামেলা এড়ানো, প্রশাসনকে ভয় দেখানো, ব্যবসায়ী বা ঠিকাদারের কাছ থেকে টাকা আদায়, আর রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো।
চিকিৎসক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিক, শিক্ষক ও ঠিকাদার এমন অনেকেই নিজেদের ব্যবসা রক্ষার ‘শিল্ড’ হিসেবে ব্যবহার করছেন এই কার্ড।
এক ঠিকাদার বললেন, কার্ড থাকলে কেউ ঝামেলা করে না। টেন্ডারের সময়ও কেউ বাধা দিতে আসে না। বরং উল্টো ভয় পায়।
একজন ড্রাইভার বললেন, প্রেস কার্ড থাকলে পুলিশ গাড়ি ধরে না। তাই অনেকে কার্ড বানাচ্ছে শুধু জরিমানা না খাওয়ার জন্য।
রাজনীতিতে সক্রিয়দের কাছে এই কার্ড ‘সুবিধা আদায়ের মাস্টার কী’—এটাই এখন ওপেন সিক্রেট।
এক উপজেলায় ৮টি প্রেসক্লাব—সদস্য ২৫০ ছাড়িয়েছে
সাতক্ষীরার শ্যামনগরে বর্তমানে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তা সত্যিই বিস্ময়কর। একটি উপজেলায় রয়েছে আটটি প্রেসক্লাব—
শ্যামনগর উপজেলা প্রেসক্লাব: ৪০ জন
অনলাইন নিউজ ক্লাব: ৪০+ জন
শ্যামনগর রিপোর্টার্স ক্লাব: ৩০ জন
সুন্দরবন প্রেসক্লাব: ২৪ জন
উপকূলীয় প্রেসক্লাব: ১৬ জন
সীমান্ত প্রেসক্লাব: ১৭ জন
সীমান্তবর্তী প্রেসক্লাব: ১০ জন
রিপোর্টার্স ইউনিটি: ২৬ জন
এসব সংগঠনের বাইরে আরও ৭০–৭৫ জন ব্যক্তি নিজেদের ‘স্বাধীন সাংবাদিক’ পরিচয়ে চলাফেরা করছেন। মোট সংখ্যা তিন শতাধিক।
উপজেলা প্রশাসন থেকে শুরু করে থানা, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, শিক্ষা অফিস—কোথাও শান্তি নেই।
একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বললেন, এত সাংবাদিক আমরা জীবনে দেখিনি। আবদার পূরণ না করলে সিরিজ নিউজ। অনেকে সরাসরি টাকা চান। না দিলে ফেসবুক-ইউটিউবে ভুয়া প্রচারণা চালায়।
আরেকজন কর্মকর্তার বলেন,বাংলাদেশে এমন আর কোনো উপজেলা আছে কিনা জানি না,যেখানে এত সাংবাদিক ঘোরে!
বাজারের মুদি দোকানি সাব্বির বললেন, এখন সাংবাদিক দেখলেই হাসি পায়। যার কোনো কাজ নেই সেই কার্ড বানায়। আসল সাংবাদিকরা তো চোখেই পড়ে না।
স্কুলশিক্ষক ইয়াসুনুর রহমান বলেন,যারা পড়াশোনাই জানে না, তারাই এখন আমাদের স্কুলে এসে হুমকি দেয়। এটা সাংবাদিকতার নামে চাঁদাবাজি ছাড়া কিছু না।
মাইক্রো ড্রাইভার রফিকুল ইসলাম বলেন, আমার পাশের চালকেরও প্রেস কার্ড আছে। বলে,পুলিশ ধরবে না, আর চাঁদাও দিতে হবে না’। এটা কোন ধরনের সাংবাদিকতা?
ব্যবসায়ী শিমুল বললেন,সাংবাদিকতা একসময় সম্মানের পেশা ছিল। এখন সেটা ঠাট্টার জায়গায় দাঁড়িয়েছে।
‘আমরা লজ্জায় পড়ছি’—জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের দীর্ঘশ্বাস
শ্যামনগরের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আবু সাইদ বললেন, যারা সত্যিকারের সাংবাদিকতা করি, তারাও আজ প্রশ্নবিদ্ধ। সরকারের কাছে দাবি—ভুয়া অনলাইন পোর্টাল বন্ধ করুন, প্রেস কার্ড কঠোর যাচাই ছাড়া ইস্যু করবেন না।
বর্ষীয়ান সাংবাদিক শেখ আফজালুর রহমানের বলেন, ২০–৩০ বছর সম্মান নিয়ে কাজ করছি। এখন আমরাও লজ্জায় মুখ দেখাতে পারি না। কিছু কার্ডবাজ সব নষ্ট করে দিয়েছে।
সমাধান স্পষ্ট—এখনই হস্তক্ষেপ দরকার
সত্যিকারের সাংবাদিকতা টিকিয়ে রাখতে সরকার ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরের দ্রুত পদক্ষেপই একমাত্র পথ।
যা প্রয়োজন—
১. জাতীয় পর্যায়ে প্রেস কার্ড ইস্যুর কেন্দ্রীয় ডাটাবেজ ও যাচাই-বাছাই ব্যবস্থা চালু।
২. ভুয়া ও নিষ্ক্রিয় অনলাইন পোর্টালের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা।
৩. চাঁদাবাজি ও প্রতারণায় জড়িতদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন।
নইলে শ্যামনগর শুধু একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে না, দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়বে ‘কার্ডবাজ সাংবাদিকতা’। আর সত্যিকারের সাংবাদিকতা হারাবে তার অস্তিত্ব।
Leave a Reply