ঘষেমেজে পরিষ্কার হচ্ছে আগুনে পোড়া ক্লাসরুমগুলো। দেয়াল ধুয়ে মুছে ফেলা হচ্ছে সব দাগ, মেঝে থেকে তুলে ফেলা হচ্ছে ঝলসে যাওয়া মাংসের গন্ধ, রক্তের দাগ, ছেঁড়া হাড়গোড় আর সেই বেদনাময় চিৎকারের ছাপ। যেন কারও না দেখা যন্ত্রণা সরিয়ে ফেলা হচ্ছে ঝকঝকে এক ‘স্বাভাবিকতা’র ভেতর।
রোববার থেকে স্কুল খুলছে আবার, যেন কিছুই হয়নি, সবকিছু স্বাভাবিক। শিশুরা ফিরবে বই হাতে, তাদের চোখে আবারও নতুন স্বপ্ন, স্কাই সেকশন, ক্লাউড সেকশনের শিশুরা। চিরচেনা বেঞ্চে বসে খুঁজবে তাদের চেনা পরিচিত বন্ধুদের প্রিয় মুখগুলো। তারা আর ফিরবে না কোনোদিন, বেঞ্চে পড়ে থাকবে শুধু পোড়া গন্ধ আর অজস্র পোড়া স্মৃতি।
কেউ আর কথা বলবে না, কেউ হাসবে না আর, নতুন করে বলবে না কোনো গল্প। শুধু বেঞ্চগুলোতে থেকে যাবে ঝলসে যাওয়া গন্ধ, নীরব নিস্তব্ধতা, একরাশ ভয় তাদের অন্তরে। এই ক্লাসেই তো একসাথে বসে পড়তো, গাইত গান, এই মাঠেই তো তারা দৌড়াতো, এই করিডোরেই টিফিন খেয়ে করতো হইচই।
আজ সেখানে নিঃশব্দ, নীরবতা, দেয়ালগুলো যেন কান্না চেপে রেখেছে ভিতরে। একেক মায়ের বুক ফাটা আর্তনাদ, এক পিতার নিঃশব্দ দাঁড়িয়ে থাকা। আজ তাদের অনেক প্রিয় বন্ধু নেই। তাদের হৃদয়েও আজ ফাঁকা নীরব শূন্যতা। নেই তাদের প্রিয় শিক্ষক। শিক্ষিকারাও চোখ তুলে তাকাতে পারেন না আগের মতো।
তবুও সময় পরিবর্তন নিয়মমাফিক শিশুরা আবার ক্লাসে ফিরবে। নতুন ক্লাস, নতুন সিলেবাস, হাসবে, খেলবে, গান গাইবে, ভুলে যাবে নতুন গল্পের ভিড়ে অনেক কিছু। পুরনো ভালোবাসা হয়তো চাপা পড়বে, পৃথিবী কারো জন্য থেমে থাকে না। মুখস্থ হবে ইতিহাস, ভুলে যাবে সবাই।
যে মা একবার ছুঁয়েছে তার সন্তানের পোড়া লাশ, যে ঠোঁট ছুঁয়েছিল আদরের সন্তানের নিথর কপাল, সে মা কি কোনোদিনও ভুলতে পারবে এই ইতিহাস? সে মা-বাবারা ঘুমোতে গেলে সন্তানের পোড়া গন্ধ টের পায়। চোখ বন্ধ করলেই আগুনের উত্তাপ দেখতে পায়। তার ঘর আলোকিত করা মুখটা আজ আর নেই, আসবে না কখনো, কোনোদিন।
এই ভুলে যাওয়ার পৃথিবীতে হারানোর যন্ত্রণা কখনো মুছে ফেলা যায় না। আদরের সন্তানগুলো পোড়া বেঞ্চের নিচে একটা খোলা বইয়ের পাতায় লেখা থাকবে তাদের এক-একটি অসমাপ্ত রঙিন স্বপ্নের লাইন চুপচাপ পড়ে থাকবে চিরদিন।
লেখকঃ কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক
Leave a Reply