বাংলা সাহিত্যের আধ্যাত্মিক ভাণ্ডারে সুফি কবিদের অবদান অনন্যসাধারণ। আঠারো শতকের প্রখ্যাত সুফিকবি ও মরমী সাধক হযরত আলী রজা কানু শাহ (রাহঃ) সেই ধারার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ও আউলিয়া হিসেবে সমধিক পরিচিত। গভীর সাধনা ও আধ্যাত্মিক চর্চার মধ্য দিয়ে তিনি একদিকে যেমন সুফি দার্শনিকের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হন, অন্যদিকে কাব্যসাধনার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে ‘কানু ফকির’ বা ‘কানু শাহ’ নামে প্রখ্যাত হয়ে ওঠেন।
কবি আলী রজা কানু শাহ মরমী কাব্যধারায় বহু মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর সর্বাধিক খ্যাতিপ্রাপ্ত গ্রন্থ “জ্ঞান সাগর” বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ উভয় বাংলায় সুফি সাহিত্য সম্পদ হিসেবে স্বীকৃত। কবি শুধু সাহিত্যিক ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন পূর্ণাঙ্গ আধ্যাত্মিক সাধক ও তরিকতের গুরু। উইকিপিডিয়ার তথ্যানুযায়ী, তাঁর খলিফার সংখ্যা ছিল তিনশতাধিক।
চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার ওশখাইন গ্রামে অবস্থিত তাঁর মাজার আজও ভক্তমহলে তীর্থস্থান। প্রতিবছর ১৪ জানুয়ারি তাঁর ওরুশ শরীফ অনুষ্ঠিত হয়, যা ‘বিষু দিবস’ নামেও পরিচিত। হাজার হাজার মানুষ এই আধ্যাত্মিক সমাবেশে অংশ নেন। বিষু কেবল বাহ্যিক উৎসব নয়; বরং এটি এক গুপ্ত আধ্যাত্মিক শিক্ষা, যা হায়াত-মউত ও ভবিষ্যৎচিন্তার এক বিশেষ পথ—যা কেবল তরিকতের জ্ঞানেই উপলব্ধি করা সম্ভব।
হস্তলিপির সন্ধান:মরমী সাধক হযরত শাহসুফি আলী রজা কানু শাহ (রাহঃ) ছিলেন দার্শনিক, ফার্সি ভাষার পণ্ডিত ও লেখক। তাঁর নিজ হাতে লেখা “জ্ঞান সাগর” ও আরও কিছু মূল্যবান হস্তলিপি আজো সংরক্ষিত রয়েছে। ২০২০ সালের ২৬ আগস্ট আনোয়ারার ওশখাইন মাজার জিয়ারতের সময় শাহাজাদা মাওলানা আবদুল কাদের (চাঁন মিয়া)-এর নিকট আমি কয়েকটি হস্তলিপি প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পাই। সেগুলো বুজপাতার কাগজে সুচারুভাবে রচিত এবং আজও যত্নে সংরক্ষিত।
এই অমূল্য হস্তলিপিগুলো অনুবাদ করে প্রকাশ করা হলে জাতি সুফি দর্শন ও আধ্যাত্মিক শিক্ষায় উপকৃত হবে। আমার এ প্রবন্ধে সেইসব হস্তলিপির একটি বাংলা অনুবাদ পেশ করছি।
হস্তলিপির বাংলা অনুবাদ: কবি আলি রজা কানু শাহ লিখছেন— “হে প্রভু! আমি আমার কলম ও কালি দ্বারা এই পত্র লিখিত করিলাম। আল্লাহর নামে শুরু করিতেছি। যিনি পরম দয়ালু, অতি দয়াশীল। মানুষ যেন সর্বদা আল্লাহর ভয়ে থাকে, এবং তাঁরই আনুগত্য করে। এই জগতে কেউই স্থায়ী নয়, সবাইকে একদিন মৃত্যুবরণ করতে হবে। সৎ কর্মই মানুষের সহচর হয়ে কবর পর্যন্ত যায়। তাই হে মানুষ! আল্লাহর উপর ভরসা কর, অন্যায় থেকে বাঁচ, এবং সৎ ও শুদ্ধ পথ অবলম্বন কর।
হে আল্লাহ! আমাদের পরকালে কল্যাণ দাও, এবং কেয়ামতের দিন রহমত বর্ষণ কর।”
সুফি সাধক ও কবি আলী রজা কানু শাহ (রাহঃ)-এর এই হস্তলিপি কেবল ধর্মীয় আহ্বান নয়; বরং এটি মানবজাতির জন্য এক অনন্ত শিক্ষা। তাঁর বাণীতে ফুটে ওঠে আল্লাহভীতি, ন্যায়পরায়ণতা ও সৎকর্মের প্রতি আহ্বান। এমন আধ্যাত্মিক দলিল প্রমাণ করে যে, সুফি সাধকেরা শুধু ধর্মীয় অনুশাসন প্রচার করেননি, বরং সাহিত্য ও দর্শনের মাধ্যমে মানবিক চেতনা জাগ্রত করেছেন। এই হস্তলিপি তাই ইতিহাসের পাতায় অমূল্য সম্পদ হয়ে থাকবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আধ্যাত্মিকতা, মানবিকতা ও সৎপথের শিক্ষা প্রদান করবে।
লেখক: পরিচালক ও সম্পাদক, ইতিহাসের পাঠশালা, চট্টগ্রাম বাংলাদেশ। সভাপতি, মুসলিম হিস্ট্রি এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ।
Leave a Reply