
মোঃ শহিদুল ইসলাম
বিশেষ সংবাদদাতা, চট্টগ্রাম
চট্টগ্রাম নগরীর ইপিজেড থানাধীন ৩৯নং ওয়ার্ডের নারিকেল তলা এলাকায় ধর্মীয় অনুপ্রেরণা, সামাজিক ঐক্য ও মানবিক কল্যাণের অঙ্গীকার নিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে অনুষ্ঠিত হয়েছে হিলফুল ফুযুল মানব কল্যাণ পরিষদ আয়োজিত দ্বিতীয় তাফসীরুল কুরআন মাহফিল। সুন্দর আয়োজন, শৃঙ্খলাবদ্ধ ব্যবস্থাপনা ও বিশিষ্ট আলেম-ওলামার অংশগ্রহণে মাহফিলটি পরিণত হয় এক মানবিক চেতনার জাগরণমেলায়।
নারিকেল তলার কেন্দ্রীয় মাঠে আয়োজিত এই তাফসীরুল কুরআন মাহফিলে এলাকাবাসীর উপস্থিতি ছিল উপচে পড়া। চারদিক জুড়ে আলোকসজ্জা ও ধর্মীয় আবহে মুখরিত ছিল পুরো এলাকা। মাহফিলের সভাপতিত্ব করেন প্রবীণ আলেমেদ্বীন ও হক সাহেব জামে মসজিদের সাবেক খতিব আলহাজ্ব মাওলানা মোহাম্মদ ইলিয়াছ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বিশিষ্ট সমাজসেবক ও শিক্ষাসংগঠক ডা. মোঃ কামাল উদ্দিন।
প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম-১১ আসনের জামায়াত মনোনীত প্রার্থী ও আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের পরিচালক আলহাজ্ব শফিউল আলম। এছাড়া বিশিষ্ট অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামী বক্তা মুফাসসিরে কোরআন মাওলানা কামরুল ইসলাম সাঈদ আনসারী (ঢাকা), মাওলানা ক্বারী মোঃ ইব্রাহীম খলিল, মাওলানা হাবীবুর রহমান, মাওলানা জিয়াউল করিম নিজামী, রফিক উদ্দিন (এমএসএস), হাফেজ মুহাম্মদ বখতিয়ার এবং ডা. মেজবাহ উদ্দিন।
শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সিনিয়র সহসভাপতি মোঃ আব্দুল আহাদ, পরিচালক মুহাম্মদ ইউসুফ, জেনারেল সেক্রেটারিসহ অন্যান্য ওলামা-মাশায়েখ ও বিশিষ্ট নাগরিকগণ।
প্রধান অতিথি আলহাজ্ব শফিউল আলম বলেন,“হিলফুল ফুযুল শুধুমাত্র ইতিহাসের অংশ নয়—এটি মানবতার এক উজ্জ্বল চেতনা। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) তরুণ বয়সে যে সংঘের সদস্য ছিলেন, তা ছিল অন্যায়ের প্রতিবাদে ও নিপীড়িতের পক্ষে এক মানবিক অঙ্গীকার। আজকের সমাজেও এই চেতনা পুনর্জাগরণের প্রয়োজন।”
তিনি আরও বলেন, “বর্তমান সমাজে অনৈতিকতা, দুর্নীতি ও বিভাজনের যে ভয়াবহতা দেখা যাচ্ছে—সেখান থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ নৈতিক জাগরণ ও ইসলামী আদর্শে ফিরে আসা।”
আন্তর্জাতিক বক্তা মাওলানা কামরুল ইসলাম সাঈদ আনসারী তাঁর বক্তব্যে বলেন, “কুরআন মানবতার মুক্তির ঘোষণা দিয়েছে। আল্লাহর বাণী বুঝে, তা প্রয়োগ করেই ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব।”
তিনি জোর দিয়ে বলেন, “যে সমাজে আল্লাহভীতি থাকবে, সেখানে অন্যায়, অন্যায্যতা ও দুর্নীতির স্থান হবে না। মুসলমানদের উচিত কুরআনের শিক্ষায় নিজেদের গড়ে তোলা এবং অন্যদের কল্যাণে কাজ করা।”
অন্যান্য বক্তারা বলেন, হিলফুল ফুযুলের মূল চেতনা ছিল মানবিক মূল্যবোধ ও ন্যায়নিষ্ঠ সমাজ প্রতিষ্ঠা। আজকের বিশ্বে ধর্মীয় অনুশাসনের পাশাপাশি মানবসেবাই প্রকৃত ইসলামের প্রতিফলন। তারা বলেন, সমাজের নেতৃত্বে থাকা প্রতিটি মানুষ যদি কল্যাণমূলক কাজে এগিয়ে আসে, তাহলে একটি ন্যায়ভিত্তিক ও সহমর্মিতাপূর্ণ সমাজ গঠন সম্ভব।
ইসলামের আগমনের পূর্বে আরব সমাজে ন্যায়বিচার ও মানবতার অভাব ছিল প্রকট। সে সময় কিছু মানবিক চিন্তাশীল ব্যক্তি একত্রিত হয়ে “হিলফুল ফুযুল” নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন, যার উদ্দেশ্য ছিল দুর্বল, অবহেলিত ও নিপীড়িতদের অধিকার রক্ষা করা।হযরত মুহাম্মদ(সা.) তখনও নবুওয়াতপ্রাপ্ত হননি, কিন্তু তিনি সেই সংঘের অন্যতম সদস্য ছিলেন।
আজ প্রায় ১৪০০ বছর পর, মানব সমাজ যখন নৈতিক সংকটে নিমজ্জিত, তখন সেই হিলফুল ফুযুলের আদর্শই মানুষকে নতুন করে চিন্তায় উদ্বুদ্ধ করছে। চট্টগ্রামের এই মাহফিল সেই প্রাচীন মানবিক চেতনারই আধুনিক প্রতিফলন। বক্তাদের মতে, এই ধারার মাহফিল গুলো যদি সারাদেশে সম্প্রসারিত হয়, তবে সমাজে সচেতনতা ও নৈতিক জাগরণ বাড়বে— যা দেশের উন্নয়ন ও শান্তির ভিত্তি গড়বে।
হিলফুল ফুযুল মানব কল্যাণ পরিষদ দীর্ঘদিন ধরে ধর্মীয় ও সামাজিক উন্নয়নমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে, শিক্ষাসহায়তা, দরিদ্র পরিবারের সহযোগিতা, রক্তদান ও সমাজস চেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে সংগঠনটি এলাকায় ইতোমধ্যেই প্রশংসা অর্জন করেছে।
সংগঠনের অন্যতম পরিচালক মুহাম্মদ ইউসুফ বলেন, “আমরা চাই ইসলামি মূল্যবোধের আলোকে এক কল্যাণমুখী সমাজ গড়ে তুলতে। যেখানে ধর্ম থাকবে জীবনের অনুশাসন হিসেবে, শুধু আনুষ্ঠানিকতায় নয়।”
সিনিয়র সহসভাপতি মোঃ আব্দুল আহাদ বলেন, “যুব সমাজকে সঠিক পথে আনতে হলে তাদের সামনে বাস্তব আদর্শ তুলে ধরতে হবে। হিলফুল ফুযুল সেই বাস্তব চেতনার ধারক।”
রাত গভীর পর্যন্ত চলে এই তাফসীরুল কুরআন মাহফিল। শেষে দেশ, জাতি ও মুসলিম উম্মাহর শান্তি, সমৃদ্ধি ও কল্যাণ কামনা করে বিশেষ মোনাজাত পরিচালনা করেন আন্তর্জাতিক ইসলামী বক্তা মাওলানা কামরুল ইসলাম সাঈদ আনসারী।মোনাজাতে সকলের হৃদয় থেকে উচ্চারিত হয় একটাই প্রার্থনা—“আল্লাহ আমাদেরকে সত্য পথে চলার তৌফিক দিন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস দিন, এবং মানবতার কল্যাণে কাজ করার শক্তি দিন।”
চট্টগ্রামের এই মাহফিলটি কেবল একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়—এটি ছিল এক নৈতিক জাগরণের বার্তা। আধুনিক সমাজে ইসলামি মূল্যবোধ ও মানবিক দায়িত্বের পুনরুজ্জীবন যে কতটা প্রয়োজন, তা এই আয়োজনের মাধ্যমেই প্রতিফলিত হয়েছে।
ধর্মীয় অনুপ্রেরণার পাশাপাশি, এটি ছিল এক সামাজিক আন্দোলনের রূপরেখা— যেখানে ব্যক্তি ও সমাজ উভয়ের উন্নয়নই লক্ষ্য। যদি এ ধারা অব্যাহত থাকে, তবে বাংলাদেশের ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কৃতিতে হিলফুল ফুযুল একটি নতুন মানবিক ইতিহাস রচনা করবে।
নারিকেল তলার এই মাহফিল আমাদের মনে করিয়ে দেয়— ন্যায়, সততা ও মানবসেবাই ইসলামের মর্মবাণী। সমাজে শান্তি ও নৈতিকতার প্রতিষ্ঠার জন্য হিলফুল ফুযুলের চেতনায় ফিরতে হবে আজই।
Leave a Reply