বিশ্বখ্যাত মুসলিম বিজ্ঞানী ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট পদ্ধতির প্রকৃত উদ্ভাবক: খান বাহাদুর কাজী আজিজুল হক
-সোহেল মো. ফখরুদ-দীন
ইতিহাসের পাতায় অনেক বর্ণিল চরিত্র স্থান পেলেও, কিছু নাম আজও রয়ে গেছে অন্তরালে—যাদের অবদান সভ্যতার অগ্রগতিকে নতুনত্ব ফিরে পেয়েছে। এমনই এক বিস্মৃত নায়ক হলেন খান বাহাদুর কাজী সৈয়দ আজিজুল হক। মুসলিম বিশ্বের গর্ব, উপমহাদেশের এক প্রতিভাবান সন্তান, যিনি ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা হস্তছাপ সংরক্ষণ ও শ্রেণিবিন্যাসের মাধ্যমে অপরাধী শনাক্তকরণের আধুনিক পদ্ধতির উদ্ভাবক। অথচ, বহুদিন তাঁর নাম ছায়ায় ঢাকা পড়ে ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের প্রচারণায়।
এই প্রতিবেদনে আমি তুলে ধরেছি খান বাহাদুর কাজী আজিজুল হক এর কর্ম জীবন। বন্ধু জন ড. মআআ মুক্তাদীর এই লেখাটির তথ্যের জন্য সহায়তা করেছেন। একজন মেধাবী বাঙালি গণিতবিদ, উদ্ভাবক ও পুলিশ কর্মকর্তার জীবন, যিনি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ছোঁয়ায় অপরাধ অনুসন্ধানকে একটি যুগান্তকারী দিশা দেখিয়েছিলেন পৃথিবী ইতিহাসে।
১৮৭২ সালে বাংলাদেশের খুলনা জেলার কসবা গ্রামে কাজী সৈয়দ আজিজুল হকের জন্ম। সে সময় উপমহাদেশে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ঘটছিল, আর আজিজুল হক ছিলেন সেই নবজাগরণের এক উজ্জ্বল প্রতিনিধি। তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে গণিতে উচ্চশিক্ষা অর্জন করেন—যা তার ভবিষ্যতের গবেষণার ভিত্তি রচনা করে দেয়। শিক্ষা জীবন শেষে ব্রিটিশ পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর পদে যোগ দেন এবং সেখানেই শুরু হয় তার বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনার প্রয়োগ।
ফিঙ্গারপ্রিন্ট পদ্ধতির সূচনা: ১৮৯২ সালে, কলকাতার ঐতিহাসিক রাইটার্স বিল্ডিং-এ কর্মরত থাকাকালে আজিজুল হক লক্ষ্য করেন, তৎকালীন অপরাধ শনাক্তকরণ পদ্ধতি—অ্যানথ্রোপোমেট্রি (মানবদেহের মাপঝোঁক)—যথেষ্ট ত্রুটিপূর্ণ ও অকার্যকর। এই পদ্ধতিতে দুই ব্যক্তির শারীরিক গঠনের পার্থক্য নির্ধারণ করা কঠিন ছিল, ফলে বারবার ভুল ব্যক্তিকে অপরাধী বলে ধরা হতো।
গণিতে সুদক্ষ আজিজুল হক সাহেব উপলব্ধি করেন, আঙুলের ছাপ (ফিঙ্গারপ্রিন্ট) প্রতিটি মানুষের জন্য এক অনন্য বৈশিষ্ট্য বহন করে, যা কখনো পরিবর্তিত হয় না। এই ভাবনার উপর ভিত্তি করেই শুরু করেন তার নিরলস গবেষণা।রাতের পর রাত, দিনের পর দিন— আজিজুল হক ডুবে যান অসংখ্য ফিঙ্গারপ্রিন্টের বিশ্লেষণে। তিনি লক্ষ করেন, আঙুলের রেখা ও ঘূর্ণির প্যাটার্ন গাণিতিকভাবে শ্রেণিবদ্ধ করা সম্ভব। তাঁর তৈরি শ্রেণিবিন্যাস পদ্ধতিতে ছিল ১০২৪টি খোপ ও ৭২টি গাণিতিক ছাঁকনি। এটি এমনভাবে তৈরি হয়েছিল, যা লাখো ছাপের মধ্য থেকে নির্দিষ্ট একটি ছাপ দ্রুত সনাক্ত করতে পারত। ১৮৯৭ সালের মধ্যেই তিনি তৈরি করেন ৭০০০টির বেশি ছাপের সংগ্রহ, যা ছিল সে সময়কার সবচেয়ে বিশাল ফিঙ্গারপ্রিন্ট ডাটাবেস। এই পদ্ধতি ভবিষ্যতে অপরাধ শনাক্তকরণের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে এবং আজও এই ভিত্তির উপর ভিত্তি করেই আধুনিক ফিঙ্গারপ্রিন্ট সিস্টেম তৈরি।
অবদান ছিনতাই ও ‘হেনরি সিস্টেম’ : আজিজুল হকের এই বিশাল অবদানের স্বীকৃতি যেভাবে পাওয়া উচিত ছিল, তা তিনি পাননি। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রশাসন চেয়েছিল—এই পদ্ধতিকে একজন ইউরোপিয়ান কর্মকর্তার নামে প্রতিষ্ঠা দিতে। সেই কর্মকর্তার নাম ছিল স্যার এডওয়ার্ড হেনরি। যদিও আজিজুল হক ই এই শ্রেণিবিন্যাস পদ্ধতির মূল উদ্ভাবক, এবং তার সহকর্মী হেমচন্দ্র বোস এই কাজে তাঁকে সহায়তা করেছিলেন, তথাপি পুরো সিস্টেমকে ‘হেনরি সিস্টেম’ নামে চালানো হয়। আজিজুল হক তখন প্রতিবাদ না করলেও, তার মনের গহীনে ছিল এক নিঃশব্দ বিদ্রোহ। উপনিবেশিক প্রশাসন আজিজুল হককে পুরস্কার স্বরূপ ‘খান বাহাদুর’ উপাধি, পাঁচ হাজার টাকা, এবং একটি ছোট জায়গির দেয়। পরবর্তীতে তিনি পদোন্নতি পেয়ে হন পুলিশের এসপি (সুপারিনটেনডেন্ট অফ পুলিশ)। চাকরিজীবন শেষে আজিজুল হক অবসর নেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন ভারতের বিহার রাজ্যের চম্পারান জেলার মতিহারিতে। এখানে তার নিজস্ব বাড়ি ছিল, যার নাম ছিল ‘আজিজ মঞ্জিল’। জীবনের শেষ দিনগুলো কাটান গবেষণা ও আত্মস্মরণায়। ১৯৩৫ সালে, ওখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁকে সমাহিত করা হয় তার নিজের বাড়ির সীমানার মধ্যে। স্বাধীনতার পর তাঁর পরিবারের অনেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। আজিজুল হকের উত্তরসূরিরাও নিজ নিজ ক্ষেত্রে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। তাঁর পুত্র আসিরুল হক ছিলেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা (ডিএসপি)। তাঁর বিখ্যাত নাতি হলেন বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের বিখ্যাত ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সালাহউদ্দিন আহমেদ (১৯২২–২০১৪), যিনি একজন স্বনামধন্য ইতিহাসবিদ ছিলেন। আরেক নাতনি, বেগম মুশতারী শফী (১৯৩৮–২০২১) ছিলেন একজন বিশিষ্ট সাহিত্যিক, সমাজকর্মী ও মুক্তিযুদ্ধের শহীদ জয়া। তিনি চট্টগ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন এবং নারীর অধিকার ও মুক্তচিন্তার সংগ্রামে আজীবন যুক্ত ছিলেন। আমি সোহেল মো. ফখরুদ-দীন বেগম মুশতারী সফী আপার সাথে অনেক সভা সেমিনারে যোগদান করেছি। একবার আপার জন্মদিন উৎযাপন করেছি চট্টগ্রাম নগরীর গুনী মনীষীদের নিয়ে।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও পুনর্মূল্যায়ন: যদিও আজিজুল হক জীবিত অবস্থায় তাঁর কাজের যথাযথ সম্মান পাননি, আজ ইতিহাস ধীরে ধীরে তাঁকে ফিরে পাচ্ছে। আন্তর্জাতিকভাবে আজ স্বীকৃত যে, ‘হেনরি সিস্টেম’-এর আসল কারিগর ছিলেন কাজী আজিজুল হক ও হেমচন্দ্র বোস।এই স্বীকৃতি স্মরণে গঠিত হয়েছে আন্তর্জাতিক পুরস্কার—‘The Fingerprint Society Azizul Haque and Hem Chandra Bose Prize’—যা প্রতি বছর ফিঙ্গারপ্রিন্ট প্রযুক্তি বা ক্রিমিনোলজি গবেষণায় বিশেষ অবদানের জন্য প্রদান করা হয়। খান বাহাদুর কাজী আজিজুল হক শুধু একজন পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক বৈজ্ঞানিক চিন্তক, একজন উদ্ভাবক, একজন জাতীয় গর্ব। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কাঠামোর ভেতরে থেকেও তিনি এমন এক বৈপ্লবিক প্রযুক্তির জন্ম দিয়েছিলেন, যা আজ বিশ্বব্যাপী অপরাধ দমন ও বিচারব্যবস্থার ভিত্তিমূল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাঁর জীবনের কাহিনি আমাদের শেখায়, নীরব সাধনা, আত্মবিশ্বাস ও বিজ্ঞানমনস্কতা দিয়ে যেকোনো সীমাবদ্ধতা জয় করা যায়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উচিত, এমন গর্বিত অধ্যায়গুলো তুলে ধরা—যাতে করে জাতি তার প্রকৃত ইতিহাস ও গৌরব চিনতে পারে। আজ যখন আধুনিক অপরাধ বিশ্লেষণে আমরা ফিঙ্গারপ্রিন্ট প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করি, তখন আমাদের মনে রাখতে হবে—এই প্রযুক্তির পেছনে এক নির্লোভ, নির্ভীক, বিস্মৃত বাঙালি মুসলমান বিজ্ঞানীর অধ্যবসায়ী অবদান জড়িয়ে আছে। তিনি ছিলেন খান বাহাদুর কাজী সৈয়দ আজিজুল হক—ফিঙ্গারপ্রিন্ট বিপ্লবের প্রকৃত মহানায়ক।
লেখক: সভাপতি, চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্র ও মুসলিম হিস্ট্রি এসোসিয়েশন বাংলাদেশ।
Leave a Reply