বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন যখন দোরগোড়ায়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নির্বাচনই হলো দেশের গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি। আগামী ফেব্রুয়ারি, অর্থাৎ মাত্র দুই মাস দূরে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এমন সময় সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে চট্টগ্রাম বন্দর সহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সম্পদ বিদেশী প্রতিষ্ঠানের হাতে হস্তান্তর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিয়া, নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি), বে টার্মিনাল ও কক্সবাজার রেলস্টেশন সহ দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্থাপনা ডিসেম্বরের মধ্যে চুক্তি সইয়ের পরিকল্পনা করেছে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। মাত্র দুই মাস সামনে রেখে এ ধরনের কার্যক্রম তড়িঘড়ি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষক, নাগরিক সমাজ এবং জনসাধারণ।
চট্টগ্রাম বন্দর হলো দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র। এটি হলো অর্থনীতি, কৌশল ও জাতীয় স্বার্থ। বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানির প্রায় নব্বই শতাংশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটি কেবল বাণিজ্যিক স্থাপনা নয়; এটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যনীতি, কৌশলগত নিরাপত্তা এবং সার্বভৌমত্বের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। বন্দরের নীতি, পরিচালনা এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতা দেশের অর্থনীতি, ট্রান্সপোর্ট খরচ, ব্যবসায়িক বিনিয়োগ এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নির্বাচনের মাত্র দুই মাস আগে এমন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দায়িত্বের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এটি ভবিষ্যৎ নির্বাচিত সরকারের স্বাধীন নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রকে সীমিত করতে পারে।
এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচন-পূর্ব হস্তান্তর: গণতান্ত্রিক ও প্রশাসনিক ঝুঁকি পারতে পারে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বা মেয়াদোত্তীর্ণ প্রশাসনের জন্য দেশের জাতীয় সম্পদ ও কৌশলগত স্থাপনা সংক্রান্ত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া সাধারণত বারণযোগ্য। কারণ, নির্বাচিত সরকারই ভবিষ্যৎ নীতি ও নিরাপত্তার জন্য দায়বদ্ধ।
এমতাবস্থায় ২২ অক্টোবর -বুধবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এশিয়ান নারী ও শিশু অধিকার ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও মহাসচিব মোহাম্মদ আলী বলেন, “এ ধরনের সিদ্ধান্তে স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা এবং জনগণের জানার অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি। নির্বাচন-পূর্ব হস্তান্তর গণতান্ত্রিক নীতির পরিপন্থী এবং ভবিষ্যৎ সরকারের স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণকে প্রভাবিত করতে পারে। তিনি আরও বলেন – ”চট্টগ্রাম বন্দর কেবল অর্থনৈতিক কেন্দ্র নয়; এটি দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বাণিজ্য ও নৌপথ নিয়ন্ত্রণে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। বিদেশী অপারেটরের হাতে হস্তান্তর হলে দেশের কৌশলগত নিরাপত্তা, সামুদ্রিক নীতি এবং আঞ্চলিক ভারসাম্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়তে পারে।
এই বিষয়ে বিশ্লেষকরা আরও কিছু ঝুঁকির সম্ভাবনা করছে যেমন : বন্দরের কার্যক্রমে বিদেশী নিয়ন্ত্রণ বাড়ালে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব এবং নীতি-নির্ধারণের স্বাধীনতা সীমিত হবে। বিশেষ করে, এটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তি, ভূরাজনৈতিক অবস্থান এবং আঞ্চলিক সম্পর্কেও প্রভাব ফেলতে পারে,বিদেশী প্রতিষ্ঠান কর্তৃত্বে বন্দরের নীতি পরিবর্তন হলে দেশের আমদানি-রপ্তানির খরচ, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা এবং বন্দর আয়ের মডেল প্রভাবিত হতে পারে, কর্মসংস্থান, স্থানীয় ব্যবসা ও সরবরাহ চেইনে পরিবর্তন ঘটতে পারে, নির্বাচনের আগে তড়িঘড়ি করা পদক্ষেপ রাজনৈতিক বিতর্ক, জনমতের বিভাজন এবং জনগণের আস্থা কমাতে পারে,কৌশলগত বন্দরের ব্যবস্থাপনায় বিদেশী নিয়ন্ত্রণ জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
এমন পরিস্থিতিতে সংগঠনের বিশ্লেষণ: এশিয়ান নারী ও শিশু অধিকার ফাউন্ডেশন মনে করে, দেশের জাতীয় সম্পদ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে: ১.নির্বাচিত সরকারের অংশগ্রহণ থাকা প্রয়োজন ২. জনগণকে যথাযথভাবে অবহিত করা উচিত ৩. জাতীয় স্বার্থ, সার্বভৌমত্ব এবং কৌশলগত প্রভাবকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত।
সংগঠনের মহাসচিব মোহাম্মদ আলী বলেন, “জাতীয় সম্পদ জনগণের। নির্বাচিত সরকারের হাতে সিদ্ধান্ত না রেখে তড়িঘড়ি করা জনগণের আস্থাকে হুমকির মুখে ফেলে এবং ভবিষ্যৎ নীতিনির্ধারণের স্বাধীনতাকে সীমিত করে।”
তিনি আরও বলেন – ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আসন্ন, অথচ ডিসেম্বরে চট্টগ্রাম বন্দর হস্তান্তরের তাড়া—এটি শুধু প্রশাসনিক বা রাজনৈতিক সমস্যা নয়। এটি দেশের অর্থনীতি, জাতীয় নিরাপত্তা, কৌশলগত স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের সঙ্গে সরাসরি জড়িত।
“জনগণ জানতে চায়—নির্বাচনের আগে এই হস্তান্তরের এত তাড়া কেন? কেন নির্বাচিত সরকারের হাতে এ সিদ্ধান্ত রাখা হলো না?”
এমতাবস্থায় এশিয়ান নারী ও শিশু অধিকার ফাউন্ডেশন সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে- চট্টগ্রাম বন্দরের মতো গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সম্পদ সংক্রান্ত যেকোনো পদক্ষেপ স্থগিত রাখার,নির্বাচিত সরকারের হাতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ রাখার,সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা, দায়িত্বশীলতা এবং জাতীয় স্বার্থ নিশ্চিত করার, মনে রাখতে হবে “জাতীয় সম্পদ কোনো সরকারের নয়, জনগণের। তাই জনগণের অনুমোদন ও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সিদ্ধান্ত ছাড়া এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীলতার পরিপন্থী।”
লেখকঃ প্রতিষ্ঠাতা ও মহাসচিব, এশিয়ান নারী ও শিশু অধিকার ফাউন্ডেশন।
Leave a Reply