
জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান দীর্ঘদিন ধরেই শীর্ষে। অপরদিকে, বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণে এ দেশের অবদান নগণ্য। এই বৈপরীত্যই বাংলাদেশের ন্যায়বিচারের দাবি—ক্ষতির দায় যাদের, তাদের কাছ থেকেই ক্ষতিপূরণ ও অভিযোজন তহবিল পাওয়া উচিত। কিন্তু কপ-৩০ এ এসে সেই দাবির বাস্তবতায় যে চিত্র উঠে এসেছে, তা আশাবাদের চেয়ে অনিশ্চয়তাই বেশি। যারা এই বিশ্ব মঞ্চে বসে জলবায়ু বিষয়ে ছবক দেয় তাদের দ্বারাই জলবায়ু বেশি হুমকির মধ্যে পতিত হয়। সারা বিশ্বে আজ জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় কথা বললেও তা বাস্তবে এর ছেটাফোটা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। প্রতি বছর এই জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় হাজার কোটি টাকা বাজেট ঘোষণার পরেও সেই বাজেটের ন্যায্যতা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। ক্ষতিগ্রস্ত ছোট ছোট দেশগুলো তাদের ন্যায্য বাজেট প্রাপ্তিতে থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে জলবায়ু রোধে দেখা দিচ্ছে অনীহা। এই বাজেটে চরম আকারে বৈষম্যের শিকার অনেক দেশ।
১. প্রতিশ্রুতি বনাম বাস্তবতার বৈষম্য: আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলনগুলোর ইতিহাস বলছে—ধনী দেশগুলোর প্রতিশ্রুতি যতটা বড়সড়, তাদের বাস্তবায়ন ততটাই সীমিত। ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ তহবিলকে কার্যকর করার প্রতিশ্রুতি কপ-২৭ থেকেই আলোচনায় ছিল, কিন্তু এখনো পর্যন্ত এই তহবিল পূর্ণাঙ্গ কাঠামো, তহবিল সংগ্রহ ও বিতরণ প্রক্রিয়া থেকে অনেক দূরে।
প্রতিশ্রুত অর্থের বেশিরভাগই আসে ঋণ আকারে, অনুদান নয়। ফলে যে দেশগুলো জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, তাদের ওপর আরও ঋণের বোঝা চাপছে—যা জলবায়ু ন্যায়বিচারের মূল ধারণারই পরিপন্থী।
২. বৈশ্বিক ক্ষমতার রাজনীতিতে জলবায়ু তহবিল: জলবায়ু অর্থায়ন এখন একটি স্পষ্ট ভূ-রাজনৈতিক ইস্যু।
ধনী দেশগুলো একদিকে তাদের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক মন্দা, মুদ্রাস্ফীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, এবং প্রতিরক্ষা ব্যয়ের অজুহাতে অর্থ ছাড়ে অনাগ্রহ দেখাচ্ছে; অন্যদিকে, জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো বৈশ্বিক অর্থনীতির তুলনামূলক ‘নিম্ন-অগ্রাধিকার’ প্রান্তে অবস্থান করছে।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য চ্যালেঞ্জ আরও কঠিন—
ন্যায্যতা দাবি করা সহজ, কিন্তু শক্তির ভারসাম্যহীন বৈশ্বিক রাজনীতিতে সেই ন্যায্যতা আদায় করা কঠিন।
৩. বাংলাদেশের দাবি: কেন এত জোরালো?: বাংলাদেশের দাবি শুধু অর্থপ্রাপ্তির নয়, বরং দ্রুত, শর্তহীন, এবং সরাসরি অ্যাকসেস নিশ্চিত করার। কারণ: জলবায়ু ক্ষতি প্রতিনিয়ত বাড়ছে—ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা, নদীভাঙনের বিস্তার, লবণাক্ততার অগ্রাসন, কৃষি উৎপাদন ক্ষতি। এই ক্ষতি সামলাতে দেশের বার্ষিক ব্যয় বাড়ছে, যা উন্নয়ন বাজেটকে সংকুচিত করছে।অভিযোজন (adaptation) খাতে বিনিয়োগ না বাড়ালে ভবিষ্যৎ দুর্যোগ মোকাবিলা কঠিন হবে।আন্তর্জাতিক তহবিল পেতে যে ক্রটিক জটিলতা থাকে, তা অনেক সময় প্রকল্প বাস্তবায়ন ক্ষতিগ্রস্ত করে। এ কারণে বাংলাদেশ স্পষ্টভাবে বলেছে—জলবায়ু তহবিলকে অবশ্যই গ্রান্ট-ভিত্তিক, সহজে প্রাপ্তিযোগ্য এবং জাতীয় পরিকল্পনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে।
৪. লস অ্যান্ড ড্যামেজ: প্রতিশ্রুত তহবিল নাকি রাজনৈতিক প্রতীক?: L&D ফান্ডকে উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের ন্যায্য অধিকার মনে করে, কিন্তু অনেক উন্নত দেশ এটিকে এখনো “নৈতিক দায়িত্ব” হিসেবে দেখে—আইনগত দায় নয়।
এই দৃষ্টিভঙ্গির ব্যবধানই তহবিল বাস্তবায়নের পথে প্রধান বাধা।
কপ-৩০ এ যদিও তহবিল কাঠামো নিয়ে আলোচনা হয়েছে, কিন্তু কোন দেশ কত দেবে, কখন দেবে, কীভাবে বিতরণ হবে—সেসব প্রশ্নই এখনো অস্পষ্ট। ফলে, বাংলাদেশের প্রশ্ন উঠতেই পারে—
যে তহবিলের অস্তিত্বই রাজনৈতিক টানাপোড়েনের ওপর ভিত্তি করে, সেই তহবিল থেকে কতটা বাস্তব অর্থ পাওয়া যাবে?
৫. অর্থের খরা: অভিযোজন প্রচেষ্টায় ধাক্কা: বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে জলবায়ু অভিযোজনের জন্য নিজস্ব উদ্ভাবনী পদ্ধতি অনুসরণ করছে—ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, বন্যা পূর্বাভাস ব্যবস্থাপনা, উপকূলীয় বাঁধ, ক্লাইমেট-স্মার্ট কৃষি ইত্যাদি।
কিন্তু এই উদ্যোগগুলো আরও বিস্তৃত করতে যে বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন, তা দেশের নিজের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়।জলবায়ু অর্থায়নে বিলম্ব হলে বাংলাদেশকে—উন্নয়ন প্রকল্প স্থগিত করতে হতে পারে,দুর্যোগের পর পুনর্বাসন ব্যয় বাড়তে পারে,কৃষি ও উপকূলীয় জনপদ আরও ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
৬. কপ-৩০: প্রত্যাশা থাকলেও নিশ্চয়তা কম: অনেক আলোচনার পরও কপ-৩০ এ এমন কোনো বড় পরিবর্তন হয়নি যা তহবিল প্রাপ্তি নিশ্চিত করে।
বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা চেয়েছেন দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য প্রতিশ্রুতি—কিন্তু আলোচনার ফলাফল এখনো কাগজেই বেশি, মাঠে কম।
কপ-৩০ এ যা স্পষ্ট হয়েছে—
বৈশ্বিক জলবায়ু তহবিলের কাঠামো দুর্বল,প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই,অভিযোজন বনাম প্রশমন অর্থায়নে বিরাট বৈষম্য,সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর কণ্ঠস্বর এখনো শক্তিশালী হলেও ফলশ্রুতিতে তা সীমিত।
এই বাস্তবতায় বাংলাদেশের ন্যায্যতার জন্য লড়াই অব্যাহত- বাংলাদেশের দাবি নতুন নয়—ন্যায্য, দ্রুত, শর্তহীন এবং বাস্তব অর্থায়ন।
কপ-৩০ এ যদিও প্রতিশ্রুতির মাত্রা বেড়েছে, কিন্তু বাস্তব তহবিল এখনো অনেক দূরে।
জলবায়ু ন্যায়বিচার তখনই প্রতিষ্ঠিত হবে যখন ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো প্রকৃত অর্থেই তাদের প্রাপ্য পাবে—শুধু প্রতিশ্রুতির পাহাড় নয়, বরং সেই পাহাড় থেকে নেমে আসা বাস্তব তহবিল।
তাই প্রশ্নটি এখনো অমীমাংসিত—
বাংলাদেশ কি পাবে তার ন্যায্য প্রাপ্য? নাকি প্রতিশ্রুতির বৃত্তেই ঘুরপাক খাবে আরও একটি বছর?
Leave a Reply