বার বার তাগাদা সত্ত্বেও কর্ণফুলীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ না করায় আগামী ১৫ দিনের মধ্যে হাইকোর্টের আদেশ অবমাননার অভিযোগ এনে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার চাইবে চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন।
সোমবার (১১ অক্টোবর) সকালে চাক্তাই খালের মোহনার কর্ণফুলীর তীরে সংবাদ সম্মেলনে বিষয়টি জানানো হয়।
সংগঠনের সভাপতি চৌধুরী ফরিদের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন অধ্যাপক মনোজ কুমার দেব। সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. স্বপন কুমার পালিত, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মঞ্জুরুল কিবরীয়া, চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক আলীউর রহমান, কর্ণফুলী নদী সাম্পান মাঝি কল্যাণ সমিতি ফেডারেশন সভাপতি এসএম পেয়ার আলী, সিনিয়র সহ সভাপতি জাফর আহমেদ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক লোকমান দয়াল প্রমুখ।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, হাইকোর্টের আদেশ জলাশয় সংরক্ষণ আইন ২০০০ এর ধারা ৫ অনুযায়ী খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান ও প্রাকৃতিক জলাধারের শ্রেণি পরিবর্তনের বাধা নিষেধ। এ আইনের বিধান অনুযায়ী খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণি কর্তন করা যাবে না বা উক্তরূপ অন্য কোনো ভাবে ব্যবহার করা যাবে না বা অনুরূপ ব্যবহারের জন্য ভাড়া ইজারা বা অন্য কোনোভাবে হস্তান্তর করা যাবে না।
কোনো ব্যক্তি এ আইনের বিধান লংঙ্ঘন করলে তিনি অনধিক পাঁচ বছরের কারাদণ্ডে বা অনধিক ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।
বিএস ১ নম্বর খতিয়ানের ৮৬৫১ দাগের ১৪৭ দশমিক ১০ একর জায়গা কর্ণফুলী নদী হিসেবে চিহ্নিত করে উচ্ছেদ নোটিশ দেওয়া হয় এবং মাছ বাজারকে বরাদ্দকৃত ১,৭৫,২৬৩ বর্গফুট বা ৪ দশমিক ০২৬৩ একর নদীর অংশে নতুন মাছ বাজার গড়ে উঠেছে উল্লেখ করে তা উচ্ছেদ করতে বলা হয়েছে।
মাছ বাজার ও ভেড়া মার্কেট উচ্ছেদ করার বিষয়ে হাইকোর্টের আদেশের ৪ নম্বর কলামে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু বন্দর কর্তৃপক্ষ তার তোয়াক্কা না করেই নতুন মাছ বাজার চলমান রেখেছে। ১৫ বছরের চুক্তিনামা দিয়ে কর্ণফুলী নদী দখল ও ভরাট করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ মহামান্য হাইকোর্টের আদেশ অমান্য করেছে।
২০১৯ সালের আদেশের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে নতুন মাছ বাজার উচ্ছেদ করা বাধ্যতামূলক ছিল। বন্দর কর্তৃপক্ষ মাছ বাজার উচ্ছেদ না করে নতুন করে বরফকল স্থাপনের জন্য কর্ণফুলী নদীর মাঝখানে শাহ আমানত ব্রিজের মাঝ-পিলার বরাবর ২০০০ স্কয়ার ফিট নদী নতুন করে লিজ দিয়েছে। যা সরাসরি মহামান্য হাইকোর্টের আদেশের লঙ্ঘন।
হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী কর্ণফুলী নদীতে স্থাপিত মাছ বাজার ও বরফ কলের চুক্তি বাতিল করতে ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখে বন্দর চেয়ারম্যান বরাবরে ১০ দিনের সময়সীমা দিয়ে আবেদন করা হয়।
গতকাল ছিল উক্ত আবেদনের শেষ দিন। এ বিষয়ে আজ পর্যন্ত বন্দর কর্তৃপক্ষ কোনো সিদ্ধান্ত আমাদের জানায়নি।
একই তথ্য উপাত্ত দিয়ে গত ০৩ অক্টোবর চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান বরাবরে ১০ দিনের মধ্যে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে আবেদন করা হয়েছে। গতকাল পর্যন্ত এই বিষয়ে আমাদের কিছুই জানায়নি সিডিএ।
ফিরিঙ্গিবাজার মোড় থেকে মেরিনার্স পার্ক নতুন মাছ বাজার, ভেড়া মার্কেট থেকে বাকলিয়া চরের মোড় পর্যন্ত ৪৭ ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের দখলে থাকা সহস্রাধিক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে বিগত ২০/১২/২০২০ তারিখে উচ্ছেদ নোটিশ দিয়েছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। উক্ত নোটিশ দেওয়ার পর ১ বছর ১০ মাস অতিবাহিত হলেও রহস্যজনক কারণে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করছে না জেলা প্রশাসন। যা মহামান্য হাইকোর্টের আদেশের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, মহামান্য হাইকোর্টের রায়ের ১৫, ১৬, ১৭, ১৮ নম্বর কলামে পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালককে প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ অনুযায়ী কর্ণফুলী রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আদেশ দেওয়া হয়েছে। পরিবেশ অধিদফতর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয় মেট্রো’র পরিচালক উক্ত আদেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ২০১৮ সালে কর্ণফুলী নদীর মাঝখানে বরফকল করার ছাড়পত্র দিয়েছে। চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন এই ছাড়পত্র না দিতে আবেদন করেছিল। ২৪/৪/২০১৮ তারিখে উক্ত আবেদনের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। আমরা মহামান্য হাইকোর্টের আদেশসহ সব তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করি। কিন্তু রহস্যজনক কারণে পরিবেশ অধিদফতর চট্টগ্রাম মেট্রো’র পরিচালক আদালতের আদেশ অমান্য করে ছাড়পত্র দিয়ে কর্ণফুলী দখল সুনিশ্চিত করেছেন।
চাক্তাই ও রাজাখালী খালের মোহনায় নদী ভরাট করে মাছ বাজার গড়ে উঠায় উজানের চেয়ে ভাটির মোহনা অংশ উচুঁ হয়ে গেছে বলে চুয়েট প্রফেসর ড. স্বপন কুমার পালিতের নেতৃত্বে ২০১৮ সালের এক জরিপে দেখা যায়। যে কারণে চট্টগ্রাম মহানগরীর কোতোয়ালী, বাকলিয়া ও পাঁচলাইশ ও চকবাজার থানা এলাকায় সামান্য বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। যা চট্টগ্রাম নগরের এক-তৃতীয়াংশের সমান এলাকা।
২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট মহামান্য হাইকোর্ট কর্ণফুলীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের রায় প্রদান করেন পরবর্তীতে প্রতিপক্ষ মহামান্য সুপ্রিম কোর্টে আপিল করায় ২০১৯ সালে এপ্রিল মাসে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। রায়ে ৯০ দিনের সময় দিয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন চট্টগ্রাম, চেয়ারম্যান বন্দর কর্তৃপক্ষ, মেয়র চসিক, চেয়ারম্যান সিডিএ, মহাপরিচালক পরিবেশ অধিদফতর ও পুলিশ কমিশনার চট্টগ্রামকে আদেশ দেন মহামান্য হাইকোর্ট। ২০২০ সালের ৫-৯ ফেব্রুয়ারি পাঁচ দিন অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। পরবর্তীতে চলতি বছর লালদিয়া চরে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
Leave a Reply