রোজা একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। পুরো একটি মাসজুড়ে সিয়াম সাধনার পর আল্লাহর ইচ্ছা-অনিচ্ছার নিরিখে জীবনযাপনের মানসিকতা সৃষ্টি হয়। আল কোরআনের পরিভাষায় একেই বলা হয়েছে ‘তাকওয়া’। প্রকৃত মানুষ হওয়ার জন্যই তাকওয়া অর্জন জরুরি। রোজা কীভাবে মানুষের সম্মানিত অবস্থান বজায় রাখতে সাহায্য করে, কীভাবে মানুষকে কাঙ্ক্ষিত শুদ্ধতায় পৌঁছে দেয়, পরকালের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলে—এসব জানা রোজার উদ্দেশ্য পূরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
এক. বস্তুপ্রেমের করালগ্রাস থেকে মুক্ত করা: বস্তুপ্রেম সব পাপের মূল। অন্যায়-অনাচার, খুন, রাহাজানি, চৌর্যবৃত্তি, সুদ, ঘুষসহ মানুষ যেসব অপকর্মে লিপ্ত হয়, তার সব কটির মূলে থাকে বস্তুপ্রেম। মানুষের কাছে বস্তু হলো সৌন্দর্যের প্রতীক। সে এই প্রতীকের পেছনে দৌড়ঝাঁপে ব্যয় করে তার জীবন। আল কোরআন মানুষের এই মনমানসিকতাকে যথার্থরূপে চিত্রিত করেছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘মানুষের কাছে সুশোভিত করা হয়েছে প্রবৃত্তির ভালোবাসা, নারী, সন্তান, রাশি রাশি সোনা-রুপা, চিহ্নিত ঘোড়া, গবাদিপশু ও শস্যক্ষেত। এগুলো দুনিয়ার জীবনের ভোগ্যসামগ্রী। আর আল্লাহ! তাঁর কাছে রয়েছে উত্তম প্রত্যাবর্তনস্থল।’ (সুরা আল ইমরান, আয়াত: ১৪)।
অন্য এক আয়াতে এসেছে, ‘সম্পদ ও সন্তানেরা ইহকালের সৌন্দর্য’। (সুরা আল কাহফ, আয়াত: ৪৬)। এই প্রবৃত্তিকে পরিমিতভাবে ব্যবহার করা বৈধ। তবে মানুষ পরিমিতির সীমানা অতিক্রম করে যায় এবং প্রবেশ করে নিষিদ্ধের সীমানায়। সিয়াম সাধনার পুরো মাসজুড়ে মানুষকে বাধ্য করা হয় বস্তুপ্রেমের ঊর্ধ্বে উঠতে। ভোর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খাদ্য-পানীয় ও যৌন চাহিদা পূরণ থেকে মানুষকে বিরত রাখা হয়। খাদ্য ও পানীয় মানুষের জীবনধারণের জন্য অতীব প্রয়োজনীয় বিষয়। দীর্ঘ এক মাস দিনের বেলায় এসব থেকে বিরত রেখে মানুষকে এ শিক্ষা দেওয়া হয় যে সে কীভাবে বস্তুপ্রেমের ঊর্ধ্বে উঠবে। বস্তুর প্রেম ও প্রয়োজনীয়তাকে পরিমিত করবে। যেহেতু বস্তুপ্রেমের ঊর্ধ্বে উঠেও জীবনযাপন করা সম্ভব; অতএব এর মাধ্যমে এ-ও শেখানো হয় যে কারও কাছে থাকা অতিরিক্ত সম্পদ কীভাবে সে রিক্তের বেদনা মোচনে দান করে দিতে পারে। অভাবীর অভাব মোচনে বিলিয়ে দিতে পারে। আর এ বিলিয়ে দেওয়া মানুষকে নিয়ে যায় মানবিকতার সুউচ্চ শীর্ষতায়। বস্তুপ্রেমের ঊর্ধ্বে ওঠা আত্মিক উৎকর্ষ সাধনের জন্য অতি জরুরি বিষয়। আমাদের জন্য সারা দিন রোজা রাখার পর তারাবির নামাজকে সুন্নত করা হয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা কোরআনের প্রকৃত অর্থে ধারণ করার জন্য। আর কোরআন হলো ইসলামের মূল শক্তি। অতএব বস্তু থেকে ঊর্ধ্বে ওঠার অভিজ্ঞতা অর্জন ছাড়া ইসলামকে যথার্থরূপে ধারণ করা সম্ভবপর নয়। সিয়াম সাধনা এ অভিজ্ঞতা অর্জনে মানুষকে দারুণভাবে সাহায্য করে।
দুই. সময়ানুবর্তিতা ও নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন শেখানো: নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন সম্মানিত মানুষের অপরিহার্য একটি গুণ। ইহকালীন সম্মান ও পরকালীন মুক্তি উভয়টির জন্যই প্রয়োজন পরম শৃঙ্খলা ও নিয়ন্ত্রণবোধ এবং তার যথার্থ প্রয়োগ। শৃঙ্খলার অনুসরণ ব্যতীত কেউ ইহকালীন ও পরকালীন সম্মান ও সফলতার অবস্থানে নিজেকে অধিষ্ঠিত করতে পারে না।
পরকালের সৌভাগ্যও তার জন্য থেকে যায় নাগালের বাইরে। এ কারণেই সিয়াম সাধনা মানুষের জন্য অপরিহার্য একটি বিষয়। প্রতিদিন সুবহে সাদিক থেকেই শুরু হয় ঐশী প্রশিক্ষণের নানা দিক। যেমন সাহ্রির খাবার গ্রহণ সুন্নত। এর জন্য আলস্য জলাঞ্জলি দিয়ে আয়েশি মনের বিরুদ্ধে গিয়ে উঠে যেতে হয় খাবার গ্রহণের জন্য। সুবহে সাদিকে শুভ্ররেখা পূর্বাকাশে দৃশ্যমান হওয়ার আগেই শেষ করতে হয় খাবার গ্রহণ পর্ব। রোজা ভাঙার সময় সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গেই রোজা ভাঙা তথা ইফতার করা সুন্নত। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সব কটিই সময়ের সঙ্গে বাঁধা, যা মাহে রমজানে খুব গুরুত্বসহ আদায় করা হয়। এসবের মাধ্যমে মানুষকে সময়ানুবর্তিতা ও নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন পদ্ধতি শেখানো হয়।
তিন. পরকালমুখী জীবনযাপন প্রশিক্ষণ: পরকাল মানবজীবনের শেষ ঠিকানা। পরকাল অনন্ত, শাশ্বত। মানুষের জীবনের মূল সফলতা পরকালীন সফলতা। পরকালে যে ব্যক্তি জাহান্নাম থেকে নিষ্কৃতি পাবে ও অনন্ত সুখের জান্নাতে প্রবেশের অধিকার পাবে, সেই হবে পরম সৌভাগ্যের অধিকারী। (সুরা আল ইমরান, আয়াত: ১৮৫)।
তবে এই জান্নাতে প্রবেশের অধিকার আদৌ কোনো সহজ বিষয় নয়। তা বরং অতি মূল্যবান ও শ্রমসাধ্য এক বিষয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘জেনে রাখো, আল্লাহর সম্পদ অতি মূল্যবান।’ (তিরমিজি)।
পরকালের সুখের জান্নাত সেই পাবে যে ব্যক্তিই পৃথিবীতে সতর্ক হয়ে জীবনযাপন করবে। যা কিছু ব্যক্তির নিজের জন্য ক্ষতিকর, পরিবারের জন্য ক্ষতিকর, সমাজের জন্য ক্ষতিকর, দেশের জন্য ক্ষতিকর, এক কথায় যা কিছু মানব অস্তিত্বের জন্য ক্ষতিকর তা পরিহার করবে। ইসলাম সব ক্ষতিকর বিষয় থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছে। তবে প্রশ্ন হলো, একজন মানুষ কীভাবে সব নিষিদ্ধ ও ক্ষতিকর বিষয় থেকে বিরত থাকতে পারে। উত্তর হলো, তাকওয়ার প্রশিক্ষণ নেওয়ার মাধ্যমে; এটি কোনো সাধারণ প্রশিক্ষণ নয়, বরং সংযমের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। সিয়াম সাধনার সময় মানুষকে বৈধ বিষয় থেকেও বিরত রাখা হয়। বৈধ বিষয় থেকে বিরত থাকা শেখা হয়ে গেলে অবৈধ ও নিষিদ্ধ বিষয় থেকে বিরত থাকা সহজ হয়ে যায়। রমজানের পর অবশিষ্ট ১১ মাস সব ক্ষতিকর বিষয় থেকে বেঁচে থাকার যোগ্যতা অর্জন করা সম্ভব হয়ে ওঠে। মহানবী (সা.)–এর বক্তব্য অনুযায়ী, শুধু খাদ্য ও পানীয় থেকে বিরত থাকাটাই রোজার সর্বোচ্চ উৎকর্ষ স্পর্শ করার জন্য যথেষ্ট নয়, রোজার উৎকর্ষ স্পর্শ করতে হলে বরং সংবরণ করতে হবে জিহ্বাকেও। হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলা ও মিথ্যা অনুযায়ী আমল করা বর্জন না করবে, তার খাদ্য ও পানীয় থেকে বিরত থাকা, বিষয়টি আল্লাহর কাছে প্রয়োজনীয় নয়।’ (বুখারি)। এর অর্থ সিয়াম সাধনার মূল শিক্ষা হলো সব কর্মকে পরিশুদ্ধ করা। সব ক্ষতিকর কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকা। কেননা পরকালের জগৎ মিথ্যামুক্ত জগৎ। পরকালের জগৎ অপকর্মমুক্ত নির্মল এক সুখের জগৎ। অতএব সব অপকর্ম, সব মিথ্যা থেকে বিরত ও মুক্ত হতে হবে। সিয়াম সাধনা এ ক্ষেত্রে মানুষকে দারুণভাবে সহায়তা করে। পরকালমুখিতার অনুভূতি তীব্র করার জন্য মাহে রমজানের শেষ ১০ দিন নিজেকে মসজিদে আবদ্ধ করে রাখার তথা ইতিকাফের প্রতি উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। এ দিনগুলোয় রাসুলুল্লাহ (সা.) অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন। আমাদেরও উচিত বস্তুজগতের মায়া মোহের বাঁধন ছিঁড়ে তাকওয়ামুখী হৃদয় অর্জন করা।
লেখকঃ প্রাবন্ধিক
Leave a Reply