উপসম্পাদকীয়ঃ
হিজরত থেকে হিজরি সন। হিজরত ইসলামের মহাবিজয়ের মাইল ফলক। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কী জীবনে ইসলাম প্রচারে মক্কার কাফের মুশরিক, স্বগোত্রীয়দের নির্মম অত্যাচার, পদে পদে বাধা সহ্য করে আল্লাহর বাণী প্রচার করেছেন। কিন্তু আল্লাহর কি মহিমা। সেখানে আশানুরূপ সফলতা আসেনি। অবশেষে ৬২২ ঈসায়ী ২৪ সেপ্টেম্বর মোতাবেক ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার আল্লাহ পাকের হেকমত পূর্ণ নির্দেশে প্রিয় নবী রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন মাত্র সঙ্গী নিয়ে প্রিয় মাতৃভূমি মক্কা ছেড়ে মদিনার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। পবিত্র মদিনার, ছোট, বড় কিশোর যুবক, বৃদ্ধ সহ সর্বস্তরের মানুষ প্রিয় নবীজিকে সাদরে গ্রহণ করলেন। দলে দলে মদিনার বিভিন্ন গোত্রের লোকজন ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হলেন। মহান রব তাঁর প্রিয় হাবিবকে মদিনায় সফলতা দান করলেন। মদিনায় প্রতিষ্ঠিত হল ইসলামী রাষ্ট্রের বুনিয়াদ। এক দশক যেতে না যেতেই। ইসলামের আলোয় আলোকিত হল সারা বিশ্ব। হিজরত পরবর্তি ইসলামের মহা বিজয় প্রমাণ করে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হিজরত ছিল মহাতাৎপর্যময়। মহাবিজয়ের এই হিজরতকে স্বরণীয় করে রাখার জন্য হযরত ওমর ফারুক (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এর শাসনামলে হযরত আলী (রা) হিজরী সন প্রচলনের প্রস্তাব করলে তা সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। ৬২২ ঈসায়ীকে হিজরী সন গণনার বছর হিসাবে নির্ধারিত হয়। কোন মাস থেকে গণনা শুরু হবে এই প্রশ্ন উঠে। হযরত ওসমান (রাদিয়াল্লাহু আনহু) প্রস্তাব করলেন পবিত্র মুহররম মাসকে প্রথম মাস হিসাবে গণনা করা হোক। এই প্রস্তাব ও সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। ফলে মাহে রবিউল আউয়াল থেকে দু’মাস পিছিয়ে মুহাররম মাস থেকে হিজরী সন গণনা শুরু হল। ইসলামের পূর্বে ও চন্দ্রমাস ছিল। সেটা ধারাবাহিক ভাবে ছিল না। তাই পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা এরশাদ ফরমান:
“হে হাবিব লোকেরা আপনাকে নতুন চাঁদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছে। আপনি বলে দিন, সেটা সময়ের কতগুলো প্রতিক”।
সূরা আল বাকারা ১৮৯।
এখানে তফসিরে কানজুল ঈমানের টীকায় ব্যাখ্যা করা হয়েছে মহান রব চাঁদকে সময়ের চিহ্ন বলেছেন। একথাও বুঝা গেল চন্দ্র মাস কিভাবে গণনা করব। দিনক্ষণ কি হবে। কয়মাসে বছর হবে। এ ব্যাপারে পবিত্র কোরানে অন্যত্র স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।
“নিশ্চয় মাস গুলোর সংখ্যা আল্লাহর নিকট বার মাস। আল্লাহর কিতাবের মধ্যে যখন থেকে তিনি আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন। তন্মধ্যে চারটি সম্মানিত।
এটা সোজা দ্বীন”।
সূরা তাওবা আয়াত ৩৬।
এখানে আমরা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারছি, আল্লাহর বিধানে বছরে মাস হল বারটি এবং তা চন্দ্র মাস। সম্মানিত চারটি মাস বলতে বুঝিয়েছেন যিলকদ, যিলহজ্ব, মুহাররম ও রজব মাস কে। বুঝা গেল ইসলামের পূর্বে ও মাস গণনা ছিল। এবং তাও চান্দ্র মাস। ইসলাম পূর্ব যুগে কোন ঐতিহাসিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে বছর গণনা করা হতো। যেমন হযরত নুহ আলাইহিস সালামের বন্যা সন, হস্তি সন, নবীজীর জন্ম সন, আমুল ফুজুল সন ও আমুল ফাতাহ সন ইত্যাদি। সময় গণনার সুবিধার জন্য আল্লাহ পাক চন্দ্র ও সূর্য্যের কক্ষপথ নির্ধারণ করেছেন। এবং সেগুলো সেই নিয়ম অনুযায়ী অদ্যবধি চলছে। যেমন এরশাদ হয়েছে:
“তিনি সূর্যকে তেজস্কর ও চন্দ্রকে জ্যোতির্ময় করেছেন। এবং উহার মনজিল গুলো নির্দিষ্ট করেছেন। যাতে তোমার বছর গণনা ও সময়ের হিসাব জানতে পার। আল্লাহ পাক এটি অনর্থক সৃষ্টি করেননি। জ্ঞানী-সম্প্রদায়ের জন্য তিনি এসব
নিদর্শন বিশদভাবে বর্ণনা করেন”।
সূরা ইউনুচ আয়াত-৫।
সুরা আর রাহমানের ৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে
: “সূর্য ও চন্দ্র নির্ধারিত হিসাব অনুসারে রয়েছে”
কানজুল ঈমানের টীকায় ব্যাখ্যা করা হয়েছে। চাঁদ ও সূর্যের গতি মহান রব নির্ধারণ করে এবং সেই অনুসারে দুটি আপন আপন কক্ষ পথে তিথিগুলো অতিক্রম করে। মানুষ সে দু’টির গতি থেকে চান্দ্র ও সৌর মাস ও বছরগুলো হিসাব নির্ধারন করে।
সূরা আন-আমের ৯৬,৯৭ আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন। তিনিই প্রভাতের উম্মেষ ঘটান। তিনিই রাতকে বানিয়েছেন বিশ্রামের জন্য এবং সূর্য ও চন্দ্রকে বানিয়েছেন হিসাব করার জন্য এসবই মহাপরাক্রমশালী ও মহাজ্ঞানী কর্তৃক নির্ধারিত বিষয় এবং তিনিই হন যিনি তোমাদের জন্য নক্ষত্র রাজি সৃষ্টি করেছেন যেন সে গুলো দ্বারা সঠিক পথের দিশা পাও স্থল ও সমুদ্রের অন্ধকারে। আমি নিদর্শন সমূহ বিশদভাবে বর্ণনা করেছি জ্ঞানীদের জন্য”।
সূরা বনী ইসরাঈল আয়াত ১২ তে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন
“আমি রাত ও দিনকে দুটি নিদর্শন করেছি, রাতের নিদর্শনকে করেছি আলো ক্ষীণ এবং দিনের নিদর্শনকে করেছি আলোক উজ্জ্বল। যাতে তোমরা তোমাদের রবের অনুগ্রহ তালাশ করতে পার এবং বছর গুলোর গণনা ও হিসাব জানতে পারো। আর আমি প্রত্যেক বস্তুকে অত্যন্ত পৃথক পৃথক ভাবে প্রকাশ করে দিয়েছি”।
ইসলাম হচ্ছে সম্পূর্ণ জীবন বিধান। ব্যক্তি জীবন থেকে সমাজ জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন ব্যবস্থা পর্যন্ত স্বয়ং সম্পূর্ণ ভাবে ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় রয়েছে। এখানে কোন অপূর্ণতা নেই। বিশ্ব নবী সল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম, সলফে সালেহীন এর যুগে সব কিছুতে আরবী চন্দ্র বর্ষের প্রচলন ছিল। ইসলামী শরয়ী আহকাম ও ধর্মীয় ইবাদত সমূহের ভিত্তি হল চন্দ্র মাস।
শরীয়তের আহকাম ধর্মীয় ইবাদত সমূহের পালনের ভিত্তি হলো চন্দ্র মাসের তারিখ।তাই চন্দ্র মাসের তারিখ সঠিকভাবে জানা সংরক্ষণ করা আমাদের অবশ্যই কর্তব্য। না হলে গুরুত্বপূর্ণ দিবস সমূহ বাদ পড়ে যেতে পারে।
উপরের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম আমাদের আমলে জিন্দেগীতে চন্দ্র মাসের হিসাব জানার গুরুত্ব। বাস্তবে আমরা কি করছি? শুধুমাত্র ধর্মীয় কিছু দিবস ছাড়া আমরা চাঁদের তারিখের কোন হিসাবের ধার ধারি না। আমাদের ধর্মীয় দিবস সমূহ ভৌগোলিক ভাবে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের সাথে পার্থক্য আছে। এক দেশের তারিখের সাথে অন্য দেশের তারিখের কোন মিল নেই। সৌদি আরবের তারিখের সাথে ভারতের দিল নেই। আবার বাংলাদেশের তারিখের সাথে মালয়েশিয়া, জাপান, ইন্দোনেশিয়ার কিংবা দানা, সুমানের কোন মিল নেই। মক্কা শরীফে ঈদের দিন, বাংলাদেশে পরের দিন। এ রকম হওয়ার কারণ কি, চাঁদ, সূর্য এয় যে মানজিল গতি আহ্নিক গতি, বার্বিক গতি সম্পর্কে আমাদের উদাসিনতা, পবিত্র কোরান শরীফে স্পষ্ট ইংগিত থাকা সত্ত্বেও চাঁদের মাস, সূর্য্যের গতি সম্পর্কে আমরা বিজ্ঞান সম্মতভাবে গবেষণা করছিনা। শুধুমাত্র ধর্মীয় দিবস ছাড়া, ব্যবসা, বাণিজ্য, রাষ্ট্রীয় কাজ সমুহকে আমরা হিজরি বছর তারিখ গণনা করা ইবাদত মনে করছিনা। এখন যদি মুসলিম বিশ্বের দেশ সমূহ আন্তঃবাণিজ্য হিজরী তারিখ অনুযায়ী চাঁদের তারিখে দিয়ে শুরু করে তাহলে এক দেশের সাথে অন্য দেশের তারিখ গরমিলের কারণে বাধাগ্রস্থ হবে। রাষ্ট্রীয় চিঠি গুলো যদি চাঁদের তারিখ দিয়ে লেখা শুরু করে তাও একই রকম সমস্যায় পড়বে। এটা আমাদের জন্য লজ্জাজনক। একদিকে আমরা ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান মানি। অন্যদিকে সমাজে ব্যবসা বাণিজ্যে রাষ্ট্রীয় কর্মে কৃষ্টানদের তারিখ অনুসরণ করি। প্রতিনিয়ত খৃষ্টানদের ধারস্থ হই। সম্পূর্ণ জাগতিক কাজ কর্মে খৃষ্ট বর্ষ অনুসারে করি। তাহলে আমরা জাগতিক কর্ম সমূহকে ইবাদত মনে করছিনা যদি আমাদের ইহকালিন কর্ম সমূহকে ইবাদতে পরিণত করতে চাই, তাহলে শবে বরাত, শবে কদর, দুই ঈদ, শবে মেরাজের মত গুরুত্বপূর্ণ দিবস সমূহ তারিখ গণনায় গরমিলের কারণে সঠিকভাবে পারছি কিনা প্রশ্ন সাপেক্ষ ব্যাপার। যদি ইহুদি নাসারাদের ফাঁদ থেকে বেড়িয়ে আসতে চাই বিশ্ব মুসলিমের উচিত হবে বিজ্ঞান মনস্ক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বসে
সার্বজনিন হিজরী ক্যালেন্ডার প্রচলন করা। দুঃখের সাথে বলতে হয় যে মুসলিমরা জ্যোতির্বিজ্ঞানের আবিষ্কারের অগ্রদূত। সে মুসলমানেরা চাঁদের আমবস্যার পূর্ণিমার হিসাব নির্ণয় করতে হিমশিম খাচ্ছে। অথচ বিধর্মীরা সেই চাঁদে বসবাস করার চিন্তা করছে। আসুন আমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণভাবে বিশ্ববাসির কাছে তুলে ধরার স্বার্থে আল্লাহর রজ্জুকে শুদ্ধভাবে আকড়ে ধরি একতার মেলবন্ধনে বিশ্ব মুসলিম আবদ্ধ হই।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গ্রন্থপ্রণেতা।
Leave a Reply