মোঃ শফিকুল ইসলাম
সিনিয়র রিপোর্টারঃ
প্রান্তিক নারী উদ্যোক্তারা দেশের অর্থনীতির এক নীরব চালিকাশক্তি। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তারা নিজেদের কঠোর পরিশ্রম ও সৃজনশীলতার মাধ্যমে অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করছেন। তবে, তাদের এই যাত্রাপথ এখনো মসৃণ নয়। তাদের অধিকার নিশ্চিত করা, চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহায়তা করা এবং দেশের অর্থনীতিতে তাদের অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
প্রান্তিক নারী উদ্যোক্তাদের অধিকার এবং সংগ্রাম
একজন প্রান্তিক নারী উদ্যোক্তার প্রধান অধিকার হলো আর্থিক স্বাধীনতা ও সহজ শর্তে ঋণ প্রাপ্তি। তাদের সংগ্রাম শুরু হয় মূলত পুঁজির অভাব থেকেই। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ঋণ পেতে জামানতের কঠোর শর্ত, জটিল প্রক্রিয়া এবং লিঙ্গ-ভিত্তিক বৈষম্যের কারণে তারা প্রায়শই বঞ্চিত হন। এই আর্থিক বঞ্চনা তাদের উদ্যোগকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করে দেয়।
দ্বিতীয়ত, তাদের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়নের অধিকার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। গ্রামের একজন নারী উদ্যোক্তা হয়তো খুব ভালো হাতের কাজ জানেন, কিন্তু আধুনিক বিপণন কৌশল, ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম বা পণ্য প্যাকেজিং সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই। এই জ্ঞানের অভাবে তাদের পণ্য স্থানীয় বাজারের বাইরে পৌঁছাতে পারে না।
তৃতীয়ত, নিরাপদ ও সম্মানজনক কর্মপরিবেশের অধিকার তাদের প্রাপ্য। পরিবার ও সমাজের অনেক ক্ষেত্রেই তাদের কাজের মূল্যায়ন করা হয় না। ব্যবসা করতে গিয়ে তাদের বিভিন্ন ধরনের সামাজিক বাধা, নেতিবাচক মন্তব্য এবং হয়রানির শিকার হতে হয়।
সমস্যা এবং সমাধান
১. পুঁজির অভাব:
সমাধান: সরকার এবং এনজিওগুলো সহজ শর্তে, কম সুদে এবং জামানতবিহীন ঋণের ব্যবস্থা করতে পারে। ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্পগুলোতে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ রাখা গেলে এই সমস্যার অনেকটাই সমাধান হবে।
২. বাজারজাতকরণ ও বিপণনের সমস্যা:
সমাধান: স্থানীয় পর্যায়ে পণ্য প্রদর্শনী ও মেলার আয়োজন করা যেতে পারে। একই সঙ্গে, সরকারি সহায়তায় একটি ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে তাদের পণ্যগুলো সারা দেশে এবং বিদেশেও বাজারজাত করার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে।
৩. প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাব:
সমাধান: প্রত্যন্ত অঞ্চলে ডিজিটাল মার্কেটিং, অনলাইন পেমেন্ট এবং আধুনিক ব্যবসা পরিচালনার উপর নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি। মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করাও গুরুত্বপূর্ণ।
৪. সামাজিক ও পারিবারিক সমর্থনহীনতা:
সমাধান: পরিবার ও সমাজে নারীর অর্থনৈতিক ভূমিকা সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে বোঝাতে হবে যে, একজন নারী উদ্যোক্তা শুধু নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করছেন না, বরং পুরো পরিবার ও সমাজের উন্নয়নেও অবদান রাখছেন।
দেশের অর্থনীতিতে তাদের অবদান
প্রান্তিক নারী উদ্যোক্তারা দেশের অর্থনীতিতে যে অবদান রাখেন, তা অনেক ক্ষেত্রেই অলিখিত থেকে যায়। তারা নিজেদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে একদিকে যেমন নিজস্ব পরিবারের আর্থিক সক্ষমতা বাড়াচ্ছেন, তেমনি স্থানীয় অর্থনীতিকেও চাঙ্গা করছেন। তাদের উদ্যোগের ফলে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে, যা বেকারত্ব কমাতে সাহায্য করে।
গ্রামীণ হস্তশিল্প, কুটির শিল্প, কৃষিভিত্তিক পণ্য উৎপাদন এবং ছোট ব্যবসা পরিচালনার মাধ্যমে তারা জাতীয় উৎপাদন ও রপ্তানিতে পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখছেন। যখন একজন প্রান্তিক নারী স্বাবলম্বী হন, তখন তার সন্তানের শিক্ষা এবং পরিবারের স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত হয়, যা মানবসম্পদ উন্নয়নেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
পরিশেষে বলা যায়, প্রান্তিক নারী উদ্যোক্তাদের অধিকার নিশ্চিত করা, তাদের সমস্যা সমাধানে সহায়তা করা এবং তাদের অবদানের স্বীকৃতি দেওয়া কেবল একটি সামাজিক দায়িত্বই নয়, বরং দেশের টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যও এটি অপরিহার্য।
Leave a Reply