বাংলাদেশের মুক্তির ইতিহাসে কিছু মানুষ আছেন, যাঁদের জীবন জাতির অমূল্য সম্পদ হয়ে আছে। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন বঙ্গবীর জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী (১৯১৮–১৯৮৪)। তিনি শুধু একজন সেনাপতি নন, বরং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার এক অবিস্মরণীয় প্রেরণা। তাঁর নেতৃত্ব, দূরদৃষ্টি ও দেশপ্রেম জাতিকে স্বাধীনতার পথে অগ্রসর করেছে।
জন্ম ও শিক্ষাজীবন: ১৯১৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর সিলেট জেলার বালাগঞ্জ থানার দয়ামীর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এম. এ. জি. ওসমানী। তাঁর পিতা খান বাহাদুর মফিজুর রহমান ছিলেন ব্রিটিশ প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা, মাতা জোবেদা খাতুন। শৈশব-কৈশোর কেটেছে আসাম ও সিলেটে। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন মেধাবী। ১৯৩৪ সালে সিলেট গভর্নমেন্ট পাইলট হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় সমগ্র ব্রিটিশ ভারতে প্রথম স্থান অর্জন করে তিনি আলোড়ন সৃষ্টি করেন। আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন।
সেনা জীবনের অভিজ্ঞতা: ১৯৩৯ সালে তিনি ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মাত্র ২৪ বছর বয়সে মেজর পদে উন্নীত হন, যা ছিল অভাবনীয় কৃতিত্ব। দেশবিভাগের পর তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের গঠন ও সম্প্রসারণে নেতৃত্ব দেন। সেনা জীবনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে তিনি অভিজ্ঞ, কঠোর শৃঙ্খলাবদ্ধ ও দূরদর্শী সেনানায়ক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সর্বাধিনায়ক: ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে জাতির জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন ছিল অভিজ্ঞ নেতৃত্ব। তাজউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত মুজিবনগর সরকার এম. এ. জি. ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে নিয়োগ করে। তাঁর রণকৌশলেই বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে গেরিলা ও নিয়মিত বাহিনী সংগঠিত করা হয়। সীমিত অস্ত্র, অপ্রশিক্ষিত যুবক, স্বল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে তিনি পুরো মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। তাঁর নির্দেশেই নৌ-কমান্ডো ও ক্ষুদ্র বিমানবাহিনী গঠিত হয়।ওসমানীর কৌশল ছিল শত্রুকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা এবং ধীরে ধীরে আঘাত হানা। তাঁর দৃঢ় মনোবল মুক্তিকামী বাঙালিকে আত্মবিশ্বাস দিয়েছিল। ডিসেম্বরের মুক্তি-পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি দৃঢ়ভাবে মুক্তিবাহিনীকে নেতৃত্ব দেন।
স্বাধীনতার পর: দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি প্রথম সেনাপ্রধান নিযুক্ত হন। পরবর্তীতে মন্ত্রিসভায় যোগ দেন এবং সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিপুল ভোটে বিজয়ী হন। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ভিন্নমতের কারণে তিনি দলীয় রাজনীতি থেকে দূরে সরে যান। জাতীয় জনতা পার্টি গঠন করে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হন, যদিও সাফল্য পাননি।
প্রয়াণ ও স্মৃতিচিহ্ন: ১৯৮৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি লন্ডনে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় তাঁকে সিলেটে সমাহিত করা হয়। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ওসমানী মেমোরিয়াল হল, ওসমানী উদ্যান, সিলেট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ওসমানী মেডিকেল কলেজসহ নানা প্রতিষ্ঠান। তাঁর পৈত্রিক এলাকা বর্তমানে ওসমানীনগর উপজেলা নামে পরিচিত।
বঙ্গবীর জেনারেল এম. এ. জি. ওসমানী শুধু একজন সেনাপতি নন, তিনি ছিলেন স্বাধীনতার সংগ্রামে জাতির প্রেরণার আলো। তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় বাঙালি জাতির আত্মমর্যাদা, সাহস ও দেশপ্রেমের প্রতীক। আজ তাঁর জন্মবার্ষিকীতে আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি এই মহান সেনানায়ককে—যাঁর নেতৃত্ব ছাড়া হয়তো স্বাধীনতার ইতিহাস এত দ্রুত রচিত হতো না। তথ্যের ঋন স্বীকার : এস এম ফরিদুল হক মুকুল, রাজনীতিবিদ ও লেখক।
লেখক : সোহেল মো. ফখরুদ-দীন, পরিচালক ও সম্পাদক, ইতিহাসের পাঠশালা, চট্টগ্রাম।
Leave a Reply