মোঃ শেখ ফরিদ মিরসরাই ।
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আয়োজিত ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে গোপালগঞ্জ শহর। দফায় দফায় সংঘর্ষ, গুলি, ককটেল বিস্ফোরণ, গাড়িতে অগ্নিসংযোগসহ নানা সহিংসতার ঘটনায় অন্তত চারজন নিহত এবং বহু মানুষ আহত হয়েছেন। পরিস্থতির নিয়ন্ত্রণে ১৪৪ ধারা জারি করার পরও অশান্তি প্রশমিত না হওয়ায় বুধবার রাত ৮টা থেকে আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
সংঘর্ষ ও মৃত্যুর মিছিল
গোপালগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. জীবিতেশ বিশ্বাস নিশ্চিত করেছেন, সংঘর্ষে চারজনের মরদেহ হাসপাতালে এসেছে, যাদের শরীরে আঘাতের চিহ্ন স্পষ্ট। তবে এখনো নিহতদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ, র্যাব, সেনাবাহিনী ও বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।
সমাবেশে হামলা, নেতৃত্বে অবরুদ্ধ এনসিপি
‘জুলাই পদযাত্রা’র অংশ হিসেবে গোপালগঞ্জ পৌরপার্কে অনুষ্ঠিতব্য সমাবেশে দুপুর দেড়টার দিকে হামলা চালানো হয়। সাউন্ড সিস্টেম ভাঙচুর, ককটেল বিস্ফোরণ এবং নেতাকর্মীদের ওপর আক্রমণের অভিযোগ উঠেছে আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গসংগঠনের কর্মীদের বিরুদ্ধে।
সমাবেশ শেষে এনসিপি নেতাদের বহনকারী গাড়িবহর ফেরার পথে গোপালগঞ্জ সরকারি কলেজের সামনে ফের হামলার শিকার হয়। পুলিশ ও র্যাবের পাহারায় সুরক্ষা দিতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও আক্রান্ত হয়। পরিস্থিতি এতটাই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় যে সেনাবাহিনী পর্যন্ত হামলার শিকার হয়, ফলে তাদের পক্ষ থেকেও ফাঁকা গুলি ছোড়া হয়।
পুলিশ ও ইউএনও’র গাড়িতে হামলা
এনসিপির কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এম রকিবুল হাসান এবং পুলিশের গাড়িতেও হামলার ঘটনা ঘটে। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা পুলিশের গাড়িতে আগুন দেয় এবং পরিদর্শনে আসা ইউএনও’র গাড়িবহরে হামলা চালায়।
আওয়ামী লীগের লোকজনই হামলা চালিয়েছে” বলে নিশ্চিত করেছেন ইউএনও নিজেই।
সেনা পাহারায় গোপালগঞ্জ ছাড়লেন এনসিপি নেতৃত্ব
চরম অবরুদ্ধ অবস্থায় পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে আশ্রয় নেন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, সদস্য সচিব আখতার হোসেনসহ শীর্ষ নেতারা। পরে সেনাবাহিনীর সশস্ত্র পাহারায় শহর ত্যাগ করেন তাঁরা।
এনসিপি’র অভিযোগ হত্যার উদ্দেশ্যে জঙ্গি কায়দায় হামলা,চালানো হয়েছে। দলটির দাবি, গোপালগঞ্জকে সন্ত্রাসীদের আস্তানা বানাতে দেওয়া হবে না।
বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ছে দেশজুড়ে
এই বর্বর হামলার প্রতিবাদে ঢাকাসহ চট্টগ্রাম, খুলনা, কুমিল্লা এবং অন্যান্য জেলায় বিক্ষোভ মিছিল করেছে এনসিপি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা।
গোপালগঞ্জের ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বৃহস্পতিবার সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।
বিএনপির প্রতিক্রিয়া
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক বিবৃতিতে বলেন,
আওয়ামী লীগ উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই হামলা চালিয়েছে। তারা আবারও দেশে ফ্যাসিবাদের বীজ বুনতে চায়।
তিনি হামলাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন এবং দেশের সব শ্রেণিপেশার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধে নামার আহ্বান জানান।
সরকারের বার্তা: ‘বিনা বিচারে কেউ ছাড়া পাবে না।
ঘটনার পরপরই সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়।
ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগ অ্যাকটিভিস্টদের এই জঘন্য কর্মকাণ্ড বিনা বিচারে ছেড়ে দেওয়া হবে না। তদন্ত করে সকল দায়ীদের বিচারের আওতায় আনা হবে।
সরকারের বিবৃতিতে আরও উল্লেখ করা হয়,
গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে এনসিপির সভায় হামলা নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন।
থমথমে পরিস্থিতি, চেকপোস্টে তল্লাশি
বুধবার রাত ৮টার পর থেকেই গোপালগঞ্জ শহরে কারফিউ জারি হয়। শহরের রাস্তা প্রায় জনশূন্য। গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে টহল দিচ্ছে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও র্যাব। পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, পরিস্থিতি আপাতত নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তবে চেকপোস্ট বসিয়ে বাড়তি নজরদারি চালানো হচ্ছে।
বিশ্লেষণাত্মক পর্যবেক্ষণ:
এই ঘটনার পর বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহনশীলতার যে সঙ্কট, তা আবারও প্রকট হয়ে উঠেছে। আন্দোলন ও প্রতিবাদে দমননীতির প্রতিফলন যেভাবে ঘটছে, তাতে দেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
Leave a Reply