সদকাতুল ফিতর একটি উত্তম সাদকাহ। এটি রমযান শরীফের রোযা পালনের সাথে সম্পৃক্ত। রমযানের রোযা ত্রুটি বিচ্যুতি হতে মুক্ত হওয়া এবং রোযার পরিপূর্ণতার জন্যই সাদকাতুল ফিতর বা ফিতরার বিধান। হাদিস শরিফে প্রিয়নবী রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামা ইরশাদ করেছেন- “বান্দার রোযা আসমান ও জমিনের মাঝখানে ঝুলন্ত থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত সদকা-ই ফিতর আদায় না করে। (দায়লমী শরীফ)
ফিতরা কী?
ঈদুল ফিতরের দিন নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে নিজের ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তান-সন্ততির পক্ষ হতে শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত পরিমাণে গরীব-মিসকিন ও অসহায়দের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের জন্য যে সদকা আদায় করা হয় মূলত ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় তাকে সদকাতুল ফিতর বা ফিতরা বলা হয়।
যাদের ওপর ফিতরা ওয়াজিবঃ
যা ঈদের দিন সুবহে সাদিক শুরু হওয়ার পূর্বে কোন কাফির মুসলমান হলে, কোন শিশুর জন্ম হলে, কোন গরীব মুসলমান সম্পদশালী হলে, এমন প্রত্যেক আযাদ মুসলমান ও নেসাবের অধিকারীর উপর সাদকায়ে ফিতর ওয়াজিব।
সাদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হওয়ার জন্য বিবেকবান, বালেগ বা প্রাপ্ত বয়স্ক, রোযাদার হওয়া এবং সম্পদের উপর এক বছর অতিবাহিত হওয়া পূর্বশর্ত নয়।
কেন ফিতরা দিবেন?
নামাযে ত্রুটি বিচ্যুতি হলে যেমন সাজদায়ে সাহু দ্বারা প্রতিকার (শুদ্ধ) করা হয় তেমনি রমযানুল মুবারকে রোযার ত্রুটি-বিচ্যুতিকে সাদকাতুল ফিতর বা ফিতরা দ্বারা প্রতিকার বা বিশুদ্ধভাবে করা হয়। যাতে আল্লাহ তাআলা কবুল করেন।
যেভাবে ফিতরা নির্ধারণ করা হয়ঃ
সাদকায়ে ফিতরের পরিমাণ হচ্ছে গম বা এর আটা বা ছাতু “অর্ধ সা” এবং খেজুর, মুনাক্কা, যব বা এর আটা বা ছাতু ‘এক সা’। কেজির ওজন হিসেবে এক সা’ সমান বর্তমান প্রচলিত ওজনে- প্রায় ৪ কেজি ১০০ গ্রাম এবং অর্ধ সা’ সমান প্রায় ২ কেজি ৫০ গ্রাম হয়ে থাকে। সেই হিসেবে এবারের ফিতরা ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ ও আনজুমান ট্রাস্ট ১১৫/-টাকা জনপ্রতি ফিতরা নির্ধারণ করেছে।
ফিতরা কাদেরকে দিবেন?
যাকাত আদায়ের যে সব খাত রয়েছে সে সব খাতে সাদকাতুল ফিতর আদায় করা যাবে। অর্থাৎ যাদেরকে যাকাত দেয়া যায়, তাদেরকে ফিতরাও দেয়া যায়। তবে যাকাত আদায়কারী তথা নেসাবের মালিককে ফিতরা দেয়া যাবে না।
উল্লেখ্য যে, যাকাত ফিতরা প্রদানের সময় নিকটতম গরীব আত্মীয়-স্বজনদের প্রতি লক্ষ্য রাখা জরুরি একদিকে তারা গরীব অপরদিকে আত্মীয়তার হক। তবে কেউ যদি নিজেদের সমস্ত যাকাত-ফিতরা কোন লিল্লাহ্ বা মিসকিন ফাণ্ডে প্রদান করে সেক্ষেত্রেও যাকাত ফিতরা আদায় হয়ে যাবে। সূত্রঃ- [ফতোয়ায়ে-ফয়জুর রসূল: কৃত- মুফতি জালাল উদ্দীন আমজাদী রাহ., দুরুল মুখতার, আলমগীরি, রদ্দুল মুহতার ও বাহার-এ শরীয়ত ইত্যাদি।
ঈদুল ফিতরঃ মাহে রমজানের দীর্ঘ এক মাস সিয়াম পালন কারীদের জন্য শাওয়ালের চাঁদ নিয়ে আসে পবিত্র ঈদুল ফিতর। চাঁদ উদিত হলে ঈদের রাত বছরের অন্যতম শ্রেষ্ঠরাত। তাই ঈদের রাতে সাধ্যমত ইবাদত বন্দেগী করার চেষ্টা করবেন।
পবিত্র ঈদের জামা’আতের সামাজিক ও
ধর্মীয় অনেক তাৎপর্যবহ। বস্তুতঃ সিয়াম সাধনা আমিত্ব, গর্ব, বড়াই, কাম, ক্রোধ, লোভ ইত্যাদি পাশবিক রিপুকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। শবে কদরের ইবাদত, ইতেকাফের আমেজ, ঈদের পূর্ব রাতের দোআ কবুলের সুযোগ, তারাবিহর নামাযে কুরআনের অমীয় বাণী শুনে রোজাদারের হৃদয় আল্লাহমুখী হয়ে যায়। উপবাসে দুঃখী মানুষের কষ্টের অনুভব, ইফতারিতে মেহমানদারির আনন্দ, সদাকাতুল ফিতর দানে গরিবদের প্রতি সহানুভূতি, সব মিলিয়ে এক নির্মল, নিষ্কলুষ মন নিয়ে পবিত্র ও আনন্দময় পরিবেশে সিয়াম পালনকারী ঈদের ময়দানে হাযির হন।
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- ঈদের নামায সমাপনকারীরা এমন নিষ্পাপ অবস্থায় ঈদগাহ থেকে স্বগৃহে ফিরে যায় যেন তারা নবজাতক শিশুর ন্যায় নিষ্পাপ। কিন্তু যে ব্যক্তি শারীরিক শক্তি থাকা সত্ত্বেও সাওম (রমযানের রোযা) পালন করেনি, আল্লাহর বিধান অলঙ্ঘনীয় ফরয তরক করতে ভয় পায়নি।
আর এই মুবারক সময়ে ইবাদত বাদ দিয়ে যে ভোগ বিলাসে মত্ত থেকেছে এবং নাফরমানীতে লিপ্ত ছিল, ঈদের আনন্দ তার জন্য নয়, তার জন্য এদিন দুঃখের দিন, অনুতাপের দিন,শোকের দিন।
হাদীসে পাকে উল্লেখ রয়েছে- হযরত আবূ সাঈদ খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার দিনে ঈদগাহের দিকে বের হয়ে সেখানে গিয়ে প্রথমে যা করতেন তা হল নামায। অতঃপর ফিরে জনতার দিকে মুখ করে দাঁড়াতেন আর মুসলিম জনতা তখন নিজেদের কাতারে বসে থাকতেন। তিনি তাদের উপদেশ দিতেন এবং নির্দেশ দিতেন। আর যদি কোথাও কোনো সৈন্য প্রেরণের ইচ্ছা করতেন তাহলে তাদেরকে বাছাই করতেন অথবা যদি কাউকে কোনো নির্দেশ দেবার থাকে দিতেন। অতঃপর বাড়ি ফিরতেন। [ সহীহ বুখারী শরীফ: ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৩১ ]
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর এর ঈদঃ
আমীরুল মুমীনীন হযরত ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ঈদের দিনে নিজ পুত্র হযরত আবদুল্লাহকে পুরাতন কাপড় পরিহিত অবস্থায় দেখে কেঁদে দিলেন, পুত্র বললেন, আব্বাজান আপনি কেন কাঁদছেন? হযরত ফারুকে আজম বললেন, আজকের ঈদের দিনে অন্যান্য ছেলেরা যখন তোমাকে পুরাতন ছেঁড়া কাপড় দেখবে তখন তোমার অন্তর ভেঙ্গে যাবে। ছেলে জবাব দিলেন, অন্তর তো তারই ভেঙ্গে পড়বে যে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারেনি, যে পিতামাতার অবাধ্য হয়েছে, আমি তো আশা রাখি আপনার সন্তুষ্টির নিমিত্তে আমার আল্লাহও আমার উপর সন্তুষ্ট। এ কথা শুনে হযরত ফারুকে আজম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু কেঁদে দিলেন, স্বীয় পুত্রকে জড়িয়ে আলিঙ্গন করলেন এবং তাঁর জন্য দুআ করলেন। (মোকাশেফাতুল কুলুব, পৃ. ৭১০)
ঈদের জামা’আতের সামাজিক ও ধর্মীয় অনেক তাৎপর্যঃ
ঈদগাহে মুসলমানদের জামায়েত হওয়ার ফলে এলাকার প্রতিবেশী বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সাথে সাক্ষাত ঘটে। এতে মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায় এবং মুসলমানদের মধ্যে একে অপরের প্রতি শুভেচ্ছা বিনিময় করার সুযোগ পায়। প্রতিবেশী মুসলমান ভাইয়ের খোঁজ-খবর জানা যায় এবং বিপদগ্রস্ত মানুষের প্রতি সহানূভুতি প্রকাশের সুযোগ আসে। উপদেশ ও নসীহত এবং শরীয়তের বিভিন্ন বিধান সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়।
এতে মুসলমানদের অভ্যন্তরীন ঐক্য ও সাম্যের ভিত্তি অত্যন্ত সুদৃঢ় হয় এবং সৌভ্রাতৃত্বের অনুশীলন হয়। যা অন্য কোন মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব হয় না। সুতরাং ঈদের সামাজিক তাৎপর্য অত্যন্ত গভীর এবং সুদূর প্রসারী।
ঈদুল ফিতরের কতিপয় সুন্নাত সমূহ: ১। ঈদগাহে যাবার পূর্বে ফিতরা আদায় করা, ২। এক পথে ঈদগাহে যাওয়া ভিন্ন পথে আসা, ৩। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পবিত্র কাপড় পরিধান করা, ৪। নামাযের পূর্বে গোসল করা, ৫। মিসওয়াক করা, ৬। সুগন্ধি ব্যবহার করা, ৭। ঈদুল ফিতরের দিন চোখে সুরমা লাগানো, ৮। যথাশীঘ্রই ফজরের নামায আদায়ের পর ঈদগাহে গমন করা, ৯। ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে খেজুর বা মিষ্টি জাতীয় দ্রব্য খাওয়া, ১০। অতি ভোরে ঘুম থেকে উঠা এবং ১১। ঈদগাহে যাওয়ার সময় তাকবীর পাঠ করা।
মহান আল্লাহ্ তা’আলা প্রিয়হাবীব রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামার উসিলায় ঈদুল ফিতরের বরকত ও ফজিলত আমাদের নসীব করুন। আ-মী-ন।
লেখক,প্রাবন্ধিকঃ
শিক্ষক-
জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া মহিলা কামিল মাদরাসা, ষোলশহর,চট্টগ্রাম।
খতিব-
মসজিদে রহমানিয়া গাউসিয়া, বায়েজিদ বোস্তামী, চট্টগ্রাম।
Leave a Reply