রক্তঝরা ১৫ আগস্ট-বিভীষিকাময় ইতিহাসের এক ভয়ঙ্কর দিন। গভীর মর্মস্পর্শী শোকের দিন, জাতীয় শোক দিবস। ১৯৭৫ সালের এই দিনে বাঙালি জাতি হারিয়েছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখতেন, স্বপ্ন দেখাতেন। স্বপ্ন দেখতেন একটি স্বাধীন, দারিদ্র্যমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের। বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলার লাল-সবুজের ক্যানভাসে একটি সৃজনশীল ও রুচিশীল বাংলাদেশের ছবি আঁকতে চেষ্টা করেছিলেন। সেই ক্যানভাসের কোন অংশেই হিংস্রতা, শত্রুতা, খুন, গুম, ধর্ষণ, রাহাজানি, লুটপাট, বিচারহীনতার কোন অস্তিত্ব থাকতো না। থাকতো না সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প। জঙ্গিবাদের কোন আখ্যান থাকতো না তাঁর রচনায়। অথচ বাঙালি জাতির সেই কান্ডারিকে থামিয়ে দেয়া হয়েছে সেই আগস্টেই। লাল সবুজের ক্যানভাসে বঙ্গবন্ধুর ছবি আঁকার সুযোগ কেড়ে নিয়েছিল তৎকালীন সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী ও উচ্চাভিলাষী বিশ্বাসঘাতকরা।
১৯২০ সালের ১৭ মার্চে জন্ম নেয়া টুঙ্গিপাড়ার দুরন্ত খোকা কালের পরিক্রমায় হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা। সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও নেতৃত্বেই আমরা পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশ। ভারতের ইসলামিয়া কলেজে অধ্যায়নকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উপমহাদেশে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হন। ভারত এবং পাকিস্তানের পাশাপাশি তৃতীয় রাষ্ট্র হিসেবে স্বতন্ত্র, স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য শেখ মুজিবুর রহমান হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯৪৭ সালে জিন্নাহর দ্বি-জাতি তত্তে¡র ভিত্তিতে সাম্প্রদায়িক ও অস্বাভাবিক রাষ্ট্র পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন, এই রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যেই বাঙালির নির্যাতিত-নিস্পেষিত হবার ফাঁদ পাতা আছে। পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই শুরু হয় পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণমূলক আচরণ। পাকিস্তান সরকারের বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে এবং শোষকদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে তিনি বহুবার কারাবরণ করেছেন। পাকিস্তানিরা এদেশের মানুষের প্রতি নির্যাতন, অবিচার, জুলুম চালিয়েছিল। মেধাশূন্য করতে হত্যা করেছে এদেশের বুদ্ধিজীবীদের। বহু অত্যাচার ও নিপীড়ন সহ্য করে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে জনগণের গণতান্ত্রিক ও স্বাধিকার আন্দোলন ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি জীবনের বিনিময়ে বাঙালি জাতির জন্যই রচনা করেন ইতিহাসের এক অমোঘ অধ্যায়। আজীবন ঔপনিবেশিক শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে, দারিদ্র্যপীড়িত, বঞ্চিত মানুষের মুক্তির সংগ্রামে এমন এক অনন্য ভ‚মিকা রেখেছিলেন, যার তুলনা বিরল।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুর সাহসী নেতৃতে বীর বাঙালি পরাধীনতার শিকল ছিড়ে স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনতে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই কালজয়ী মহাপুরুষের এক তেজোদীপ্ত ভাষণেই উদ্বুদ্ধ হয় গোটা জাতি। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর ত্রিশ লক্ষ প্রাণ ও দুই লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে সবুজের ক্যানভাসে স্বাধীন সূর্যের রক্তিম আভা ফুটে উঠে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাঙালি জাতির ইতিহাসের এক অবিভাজ্য সত্ত্বা। তিনি রচনা করেছিলেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিজয় ইতিহাস। বাঙালি জাতিকে তিনি উপহার দিয়েছিলেন একটি আদর্শ সংবিধান। ১৯৭২ এর এই সংবিধানের প্রধান চারটি মূলনীতি ছিল, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র। এই চার ভিত্তির উপরে ভর করে যাত্রা শুরু হয় স্বাধীন বাংলাদেশের। তিনি স্বপ্ন দেখতেন মানব মুক্তি আর শোষণহীন সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠার। তাঁর দৃঢ় প্রত্যয় ছিল একটি উন্নত ও স্বাবলম্বী জাতি গঠনের। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর এক আধুনিক, স্বনির্ভর জাতি গড়ে তোলার যে স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেখেছিলেন, তা আর কেউ দেখতে সক্ষম হয়নি।
সদ্য স্বাধীন হওয়া যুদ্ধবিধ্বস্ত এক দেশকে সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা সোনার বাংলায় রূপান্তর করার সংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত করেন বঙ্গবন্ধু। দেশ ও দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য তিনি বিভিন্ন সৃজনশীল উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি মজবুত ভিত্তি তৈরি হয়েছে। সেই ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েই গড়ে উঠছে বর্তমান বাংলাদেশের দ্রুত অগ্রসরমান উন্নয়ন অভিযাত্রা। স্বাধীনতার মাত্র ৪৭ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের এই অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সত্যিই বিস্ময়কর। আজকের এই উন্নয়নের জন্য বঙ্গবন্ধুর অবদান অনস্বীকার্য। বিশ্বের ৫৭তম জাতি হিসাবে মহাশূন্যে নিজস্ব স্যাটেলাইট (বঙ্গবন্ধু-১) উৎক্ষেপণ করেছে বাংলাদেশ। ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন প্রথমবারের মত বাংলাদেশে স্যাটেলাইট ভ‚কেন্দ্র স্থাপন করার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্নের বীজ বপন করেছিলেন এই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে তা বাস্তবায়িত হয়েছে। হেনরি কিসিঞ্জারের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ এখন ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম-এর ‘এশিয়ার অর্থনীতির উদীয়মান বাঘ’। বাংলাদেশ আজ পারমাণবিক যুগে প্রবেশ করেছে। বিশ্বের ৩৩তম দেশ হিসাবে পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন দেশে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারে অনেক এগিয়েছে বাংলাদেশ। বর্তমানে বিশ্বের ইন্টারনেট ব্যবহারে শীর্ষ দশে রয়েছে বাংলাদেশের নাম। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে প্রথম ই-পাসপোর্ট চালু হয় বাংলাদেশেই। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদর্শী ও সাহসী পদক্ষেপের কারণে ইতিমধ্যে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ, স্যাটেলাইট ও পরমাণু ক্লাবে যোগদান, ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণের মতো মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়নে বাংলাদেশের সাফল্য এখন বিশ্বের উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর কাছে রীতিমতো রহস্য। আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশ বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করেছে। এশিয়ার ছোট্ট বদ্বীপটি আজ বিশ্বের ৪১তম অর্থনীতির দেশ।
Leave a Reply