পলাশ সেন, চট্টগ্রাম মহানগর প্রতিনিধি:
রত্না দে থাকেন নগরীর চট্টগ্রাম বাকলিয়া তুলাতলী এলাকায়। তিনি জানান, ২ সপ্তাহ ধরে সকালে গ্যাস না থাকায় বাসায় নাস্তা বানানো যাচ্ছে না। হোটেলই ভরসা। দুপুরেও গ্যাস আসে না। ফলে দুপুরের খাবারও হোটেল থেকে এনে খেতে হয়। বিকাল থেকে গ্যাস আসা শুরু হলেও তার চাপ এত কম থাকে যে পানি পর্যন্ত গরম হয় না। রাত ১০টার পর গ্যাসের চাপ স্বাভাবিক হয়ে আসে। এরপর শুরু হয় রান্না। শুধু তুলাতলী নয়, নগরীর চট্টগ্রামে বেশ কিছুদিন ধরে এ অবস্থা বিরাজ করছে।বন্দরনগরী চট্টগ্রামের মানুষ চাহিদার তুলনায় অর্ধেক গ্যাস ও পাচ্ছে না। গত দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে গ্যাস সংকটে অনেকটা দিশেহারা হয়ে পড়েছে বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত চট্টগ্রামের প্রায় অর্ধকোটি মানুষ। রান্নার চুলা জ্বলছে না ঠিক মত, কারখানার চাকা ও ঘুরছে না, সিএনজি পাম্পে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ও নুন্যতম গ্যাস পাচ্ছে না হাজার হাজার যানবাহন। গ্যাসের চাপ না থাকায় নগরীর অধিকাংশ সিএনজি পাম্প দিনের প্রায় ৫/৬ ঘন্টা সময় বন্ধই থাকছে। এরপরও যে সময় সিএনজি ফিলিং স্টেশন গুলোতে গ্যাস পাওয়ার কথা সে সময় গ্যাসের চাপ না থাকায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে শত শত যানবাহনকে। গ্যাস সংকটের কারণে অনেক যানবাহন মালিক এখন গ্যাসের পরিবর্তে অকটেনে গাড়ি চালাতে বাধ্য হচ্ছেন। গত প্রায় দুই সপ্তাহ বেশি সময় ধরে চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ নিয়ে এমন দুরবস্থা চলতে থাকলেও কর্তৃপক্ষ রয়েছে নির্বিকার। প্রায় সাড়ে ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট জ্বালানি গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে চট্টগ্রামের গ্রাহকরা গ্যাস পাচ্ছে ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। গ্যাস সরবরাহ অর্ধেকেরও কম হওয়ার কারণে চট্টগ্রাম মহানগরীতে প্রতিদিন গ্যাসের জন্য হাহাকার করছে জনগণ। এদিকে নগরীর নাসিরাবাদ, খুলশী, জাকির হোসেন রোড, ষোলশহর, চকবাজার, কাপাসগোলা, বাকলিয়া, বহদ্দারহাট, অক্সিজেন, বায়েজিদ, হামজারবাগ, আগ্রাবাদ, মাদারবাড়ি, মোমিন রোড, আসকারদীঘির পাড়, আন্দরকিল্লা, চান্দগাঁও, বায়েজিদসহ বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের চাপ না থাকায় দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন বাসিন্দারা। তাছাড়া চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রায় ৭ হাজার বন্দি রয়েছে। এদের জন্য দুই বেলার খাবার রান্না করতে হয়। কিন্তু অনেক দিন যাবৎ কারাগারে গ্যাস-সংকট বিরাজ করছে। কারাগার সূত্র জানায়, প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত গ্যাস থাকে না।এতোগুলো মানুষের খাবার লাকড়ি দিয়ে রান্না করতে হচ্ছে। গ্যাস না থাকায় দুপুরের দিকে হোটেল গুলোতে খেতে গিয়েও বিপত্তি দেখা দেয়। খাবারের জন্য মানুষের ভিড় লেগেই থাকে। প্রতিদিন হোটেলে যেভাবে মানুষ আসে, গত দুই এক সপ্তাহ ধরে তার চেয়ে বেশি মানুষ আসছেন। বিশেষ করে দুপুরের খাবারের সময়।হঠাৎ কাস্টমারের চাপ বেড়ে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে হোটেল কর্মচারীরা জানায়, গ্যাস না থাকায় বাসা গুলোতে রান্নাবান্না হচ্ছে না।তাই হোটেলে খাবারের জন্য ভিড় লেগে যায়।এই বিষয়ে মঙ্গলবার কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডসিএল) মহাব্যবস্থাপক (বিপণন) প্রকৌশলী আমিনুর রহমান বলেন, গ্যাসের যোগান কমে গেছে। গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ার পাশাপাশি শীতের প্রাদুর্ভাব হচ্ছে। শীতকালে গ্যাস সরবরাহ কিছুটা ব্যাহত হয়। সামনের দিনগুলোতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে বলে তিনি উল্লেখ করেন। কেজিডিসিএল সূত্র জানায়, চট্টগ্রামে বর্তমানে চাহিদার অর্ধেকের চেয়ে সামান্য বেশি গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে।দৈনিক ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে ২৬০-২৬৭ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের যোগান পুরো সেক্টরে তীব্র সংকট সৃষ্টি করেছে।
এর মধ্যে কাফকো এবং সিইউএফএল উৎপাদন চালু রাখায় গ্যাসের একটি বড় অংশ তারা ব্যবহার করছে। এই দুইটি সার কারখানা বর্তমানে প্রতিটি ৪১ মিলিয়ন ঘনফুট করে দৈনিক ৮২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ব্যবহার করছে। এর বাইরে বিদ্যুৎ উৎপাদনে দেওয়া হচ্ছে কেবলমাত্র ৩৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। বাকি ১৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস দিয়ে চট্টগ্রামের শিল্প কারখানা, সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশন, বাণিজ্যিক এবং আবাসিকসহ সবগুলো খাত সামাল দেওয়া হচ্ছে। যা এক ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। সূত্র আরও জানায়, চট্টগ্রামে সার এবং বিদ্যুৎ ছাড়া সব শিল্প কারখানা,সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশন, বাণিজ্যিক এবং আবাসিক মিলে নন বাল্ক বা অন্যান্য খাতে ১৪০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হতো। এই গ্যাস দিয়ে কোনোরকমে জোড়াতালি দিয়ে টিকিয়ে রাখা হয়েছিল বিশাল এক কর্মযজ্ঞ। কিন্তু সার উৎপাদনে গ্যাসের ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির অন্যান্য খাতে গ্যাসের যোগান অস্বাভাবিক হারে কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। আগে যেখানে দৈনিক ১৪০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস দেওয়া হতো, এখন সেখানে ১০০ থেকে ১১০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস দেওয়া হচ্ছে। চাহিদার প্রায় এক চতুর্থাংশ গ্যাস কমিয়ে দেওয়ায় পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। গ্যাসের চাপ মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ায় শিল্প কারখানা সহ সবগুলো খাতই বেকায়দায় পড়েছে।
Leave a Reply