ক) ১৫ই অক্টোবর শনিবার সাহাবীয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত মাজেন বিন গাদুবা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু এর মাজার শরীফ (যা ওমান সামায়েল শহরে অবস্থিত) জোহরের নামাজের পর জিয়ারত করি। তিনি ওমানের প্রথম মুসলমান । ষষ্ঠ হিজরীতে মূর্তি পূজা ত্যাগ করে মদিনা শরীফ হাজির হয়ে প্রিয় নবী সরকারের দো-আলম রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নূরানী হাতে ইসলাম কবুল করে প্রিয় নবীর নির্দেশে ওমানে ফিরে এসে ইসলাম প্রচার করেন এবং ওমানের সামাইল এলাকায় প্রথম মসজিদ কায়েম করেন। যা পরবর্তীতে ওমানের দীর্ঘদিনের বাদশা সুলতান কাবুস বিন সাঈদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি স্বউদ্যোগে বড়ই চমৎকার ডিজাইনে ২০১৭ ইংরেজি সনে নতুনভাবে সংস্কার করতঃ দেশি-বিদেশি সকল মুসলমানের ইবাদতের জন্য উন্মুক্ত করেছেন। উক্ত মসজিদের নাম মসজিদে মাজেন বিন গদুবা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু। আরবি- ইংরেজিতে মসজিদের সামনে যার বিবরণ নেইম ফলকে স্পষ্ট ভাষায় পরিলক্ষিত হয়।
উক্ত সাহাবিয়ে রাসূলের জীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তিনি সহ তাদের গোত্রের সবাই মূর্তি পূজা ও নানা পাপাচারে লিপ্ত ছিল। তাদের মূর্তির নাম ছিল বাজের। অন্যদিনের ন্যায় একদিন পূজা করতে আসলে আল্লাহর কুদরত পাথরের মূর্তি বাজের হতে আওয়াজ আসলো তুমি আমার পূজা করলে ক্ষতি ছাড়া কোন উপকার হবে না বরং যদি উভয় জাহানের কল্যাণের প্রত্যাশা করো তবে কাল বিলম্ব না করে এখনই মোহাম্মদে আরবি কুরাইশী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট মদিনায় চলে যাও। তিনি মক্কা শরীফ হতে হিজরত করে বর্তমানে মদিনা মনোয়ারায় অবস্থান করছেন। তিনদিন যাবত পাথরের মূর্তি হতে এই জাতীয় শব্দ ও বাক্য তিনি প্রত্যক্ষ করলেন। অতঃপর সফরের অনেক কষ্ট স্বীকার করে মদিনা শরীফে পৌঁছে ইসলাম কবুল করলেন। ওমান বাসীর হেদায়ত, শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য প্রিয় নবীর খেদমতে দোয়া কামনা করে ওমান ফিরে আসলেন। ওমানে ফিরে তিনি ইসলাম প্রচার করেছেন ও মূর্তি ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচূর্ণ করেছেন। তিনি বেশ কয়েকবার হজ্ব করেছেন এবং অর্ধেক কুরআন হিফজ করেছেন। ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর “আল এসাবা” গ্রন্থের তৃতীয় খন্ডের ৪৪৬ পৃষ্ঠায়, ইমাম বায়হাকী ও তাবরানির সূত্রে হযরত মাজেন বিন গাদুবা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু কে সাহাবায়ে রাসুলের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
খ) ১৮ই অক্টোবর মঙ্গলবার সকাল ৮:৩০ ঘটিকায় ওমান মাস্কাট হয়ে বিমানযোগে সালালায় পৌঁছে হযরত আইয়ুব নবী আলাইহিস সালাম, হযরত ইমরান নবী আলাইহিস সালাম, শ্রেষ্ট ফকীহ্ ও আলেমে রব্বানী মাওলা আলী মুশকিল কোশার নুরানী আওলাদ হযরত মুহাম্মদ বিন আলী উলুবী রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং ইয়ামেন সীমান্তের নিকটে সালালায় অবস্থিত অদ্বিতীয় আশেকে রাসূল শ্রেষ্ঠতম তাবেয়ী হযরত ওয়ায়সুল করনী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু সহ বেশ কয়েকজন বুজুর্গানে দ্বীনের মাজার শরীফ জিয়ারত করি। বিশেষতঃ সালালায় হযরত সালেহ নবীর উটের বিশেষ নিদর্শনীয় স্থান জিয়ারত করার সৌভাগ্য নসিব হয়। সেখানে সালেহ নবীর বিশেষ উটের পদচিহ্ন ও রক্তের দাগ হাজার হাজার বৎসর পর এখনো পরিষ্কার দেখা যায় ওমান সরকার নেহায়েত যত্ন সহকারে তা সংরক্ষণ করেছেন। এবং জিয়ারতকারীদের জন্য উন্মুক্ত করে রেখেছেন। সাথে সাথে ওমানের রাজধানী মাস্কাট সহ প্রতিটি শহরে ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার আয়োজন অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। সালতানাতে ওমানের প্রতি লাখো লাখো শুকরিয়া ও মোবারকবাদ। বর্তমান সৌদি আরব সরকারকে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম সৌন্দর্য্যমন্ডিত আরব দেশ ওমান থেকে শিক্ষা ও সবক গ্রহণের আহবান করছি। মাগরিবের পর ওমান এয়ার যোগে আমি এবং আমার সফরসঙ্গী সকলে মাস্কাটে ফিরে রাত ১০ টায় মাহফিলে যোগদান করি। মধ্যপ্রাচ্যের খুবই সুন্দরতম দেশ ওমানের রাজধানী মস্কাটসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার মাহফিল সমূহে প্রচুর প্রবাসী ও ওমানী আরবীদের উপস্থিতি আমাকে আকর্ষণ করেছে। তদ্রূপ নবী, সাহাবী ও বিশিষ্ট অলিগণের মাজার শরীফ জিয়ারত আমি এবং আমার সঙ্গীদেরকে অনেক আনন্দ দিয়েছে। সকল প্রবাসী ও ওমান ভ্রমনকারী গণ কে এসব জিয়ারত ও আল্লাহর বন্ধুদের ফয়েজ বরকত হাসিল করা থেকে বঞ্চিত/ মাহরুম না হওয়ার অনুরোধ রাখছি। আরো খুশির বিষয় অনেক খাস ওমানি, আরবি জ্ঞানীগুণী কে এসব মাজারে জিয়ারত করতে ও পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাহফিলে দাঁড়িয়ে ” ইয়া নবী সালামু আলাইকা” , “তালায়াল বাদরু আলাইনা” আদব ও ভক্তির সাথে পাঠ করতে এবং মোনাজাতের পর মিলাদুন্নবী এর তাবারুক বিরানি ও জিয়াফত অত্যন্ত আনন্দে গ্রহণ করতে দেখে উৎফুল্ল হয়েছি। মহান আল্লাহ এ জজবা যেন সালামত রাখেন। আমীন। ওমানি বড় বড় জ্ঞানী আরবি শায়খদের মধ্যে যাঁরা আমার সাথে ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাহফিলে উপস্থিত ছিলেন এবং দাঁড়িয়ে কিয়াম ও সালাত সালাম পাঠ করেছেন তাদের মধ্যে শেখ সাঈদ বিন হাবিব বিন হেলাল আল সাদী (নায়েবে রইস মজলিসে শুরা, ওমান), শেখ হামেদ বিন নাসির বিন আলী আল ঘারবী এবং শেখ সাইফ আল গাফেরী (খতিব মসজিদে আবু বক্কর মাওয়ালেহ ,ওমান) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি মাওয়ালেহ গাউসিয়া কমিটি শাখা কর্তৃক আয়োজিত ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাহফিলে আরবিতে তকরীর করেছেন এবং প্রিয় নবীর মিলাদ তথা শুভাগমনের বিষয়ে আরবিতে অনেক কসিদা পড়েছেন। এবং আমি গুনাগারের ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর আরবি ভাষায় তকরির শুনে অনেক মুগ্ধ হয়েছেন এবং শ্রদ্ধাভরে বাংলাদেশের জনগণের ও প্রবাসীদের প্রশংসা করেছেন।
গ) ১৯ অক্টোবর বুধবার ওমানের গ্র্যান্ড মুফতি সমগ্র আরব বিশ্বের অন্যতম ইসলামী স্কলার শেখ আহমদ বিন হামদ আল খলিলির বিশেষ আমন্ত্রণে তাঁর সরকারি বাসভবনে দুপুরে আপ্যায়নে অংশগ্রহণ করি। তিনি উঁচু পর্যায়ের আলেমেদ্বীন- ওমান সরকারের নিকট তার বিশাল মর্যাদা। তিনি বিশাল মেহমানদারীর আয়োজন করেছেন, আমার সাথে দীর্ঘক্ষণ কথাবার্তা বলেছেন। বাংলাদেশের অবস্থা জেনেছেন তাঁর লিখিত বিশাল ফতোয়া ভান্ডার আমাকে উপহার দিয়েছেন এবং সময় সুযোগ মতো ওমান সফর করতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তিনি আমাকে “মুফতিয়ে বাংলাদেশ” বলে সম্বোধন করেছেন। মূলত; এটা আমার মাশায়েখ হযরাতের মেহেরবানী। আমার সাথে গ্র্যান্ড মুফতির রাজকীয় আলীশান ভবনে রাষ্ট্রীয় অতিথিদের মধ্যে আল জাজিরা ও আমেরিকার বড় আলিম এবং গাউসিয়া কমিটি ওমান কেন্দ্রীয় শাখার সভাপতি জনাব হাজী আবুল কালাম, প্রধান উপদেষ্টা মনজুরুল ইসলাম মঞ্জু, সিনিয়র সহ-সভাপতি হাজী আব্দুল মতিন, সিনিয়র সহ-সভাপতি মুজাহিদে মিল্লাত মাওলানা আব্দুস সালাম আল কাদেরী, সেক্রেটারি জেনারেল শামসুল আলম, সৈয়দ নাসির, জসীম উদ্দীন, হাজী মুসা, হাজী ইয়াকুব, হাজী কামাল পাশা, জনাব নাছির উদ্দিন বয়ান , বাবু ভাই প্রমূখ উপস্থিত ছিলেন। তারা প্রায় সব প্রোগ্রামে আমার সফর সঙ্গী ছিলেন- তাদের প্রতি শুকরিয়া।
ঘ) ইতিপূর্বে মধ্যপ্রাচ্যের নেহায়ত আকর্ষণীয় বিশ্বের অন্যতম সৌন্দর্যমন্ডিত পরিচ্ছন্ন দেশ ওমানে হুজুর কেবলায়ে আলম, শায়খে ফা’আল আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তাহের শাহ মুদ্দাজিল্লুহুল আলী ৬ বার সফর করেছেন। চট্টগ্রাম জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদ্রাসার দীর্ঘ সময়ের অধ্যক্ষ খতিবে বাঙ্গাল, আমার শিক্ষাগুরু আল্লামা জালাল উদ্দিন আল কাদেরী রহমাতুল্লাহি আলাইহি, জামেয়ার দীর্ঘদিনের শায়খুল হাদীস , শেরে মিল্লাত, উস্তাযি আল্লামা মুফতি ওবাইদুল হক নঈমী রহ: , জামেয়ার প্রধান মুহাদ্দিস বন্ধুবর হাফেজ মাওলানা সুলাইমান আনসারী, জামেয়ার আরবি প্রভাষক স্নেহের হাফেজ মাওলানা কবি আনিসুজ্জামান ও জামেয়ার মুহাদ্দিস স্নেহের মাওলানা জসিম উদ্দিন আল আযহারী একবার করে ওমান সফর করেছেন এবং তাঁরা ওমানের বিভিন্ন মাহফিলে সারগর্ভ বয়ান পেশ করেছেন। আমি গুনাহগার বিগত সময়ে সৌদি আরব, আরব আমিরাত, মিশর, পাকিস্তান, ভারত, ইরাক, ইসরাইল, ফিলিস্তিন বাইতুল মুকাদ্দাস শরীফ সফর করলেও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম আরব দেশ ওমানের সফর ইতিপূর্বে হয়নি। এই প্রথমবার ওমান সফরে যতটুকু উপলব্ধি করলাম গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ ওমান কেন্দ্রীয় পরিষদ এবং কেন্দ্রীয় পরিষদের আওতাধীন গাউসিয়া কমিটির বিভিন্ন শাখার দায়িত্ববান প্রবাসী ভাইদের আন্তরিকতা, আতিথিয়তা, দয়া-মায়া সুন্নিয়ত ও গাউসিয়তের খেদমতে একনিষ্ঠ খেদমত ও সেবা দান কখনো ভুলা যাবে না। তাঁরা সুন্নিয়ত ও গাউসিয়তের যে বাগান সাঁজিয়েছেন আমাদের মাশায়েখ হযরাত বিশেষতঃ কুতুবুল আউলিয়া বানিয়ে জামেয়া,আল্লামা হাফেয ক্বারী সৈয়দ আহমদ শাহ সিরিকোটি রহমতুল্লাহি আলাইহি, গাউছে জামান মুর্শিদে করিম আল্লামা হাফেয ক্বারী সৈয়দ মোহাম্মদ তৈয়ব শাহ রহমাতুল্লাহি আলাইহি ও আল্লামা সৈয়দ মোহাম্মদ তাহের শাহ মুদ্দাজিল্লহুল আলীর সুদৃষ্টি ও আধ্যাত্মিক ক্ষমতার ফসল মনে করি। হিংসা-বিদ্বেষ, পরস্পরের মধ্যে কাদা ছুড়াছুড়ি নয় বরং ইখলাস, আন্তরিকতা ও মোহাব্বতের মাধ্যমে এ বাগানের যথাযথ পরিচর্যা করতে পারলে বিশ্ব ভূমন্ডলে বিশেষতঃ পাক-ভারত উপমহাদেশ সহ আরব দুনিয়ায় সুন্নিয়ত ও গাউসিয়তের জোয়ার সৃষ্টি হবে গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশের মাধ্যমে; ইনশাআল্লাহ! এ কথা বুকে হাত রেখে বলতে পারি নির্দ্বিধায় । যেহেতু গাউছে জামান আলম বরদারে আহলে সুন্নাত আল্লামা হাফেজ ক্বারী সৈয়দ মোহাম্মদ তৈয়ব শাহ রহমাতুল্লাহি আলাইহি গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছেন ১৯৮৬ ইংরেজি সনে এক মহান মাকসাদ ও উদ্দেশ্য কে সামনে নিয়ে। আল্লাহর প্রকৃত আউলিয়ায়ে কেরাম খোদায়ী ইশারায় মহৎ উদ্দেশ্যে কোন কর্ম আনজাম দিয়ে থাকেন! স্বীয় নফসকে খুশি করার জন্য বা কুপ্রবৃত্তির কারণে নয়।
পরম করুনাময় রাব্বুল আলামিন দেশী-প্রবাসী সকল সুন্নি নবীপ্রেমিক ওলি আল্লাহর অনুসারী সবাইকে যেন আনজুমান, জামেয়া, সিলসিলা, শরীয়ত, তরিকত, গাউসিয়া কমিটি, দাওয়াতে খায়র ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের সহি খেদমত আঞ্জাম দেয়ার তৌফিক দান করেন সে প্রার্থনা করে ইতি টানলাম। আমিন ইয়া রব্বাল আলামীন। ওমানের সকল প্রবাসী ভাইদের জানাই আন্তরিক শ্রদ্ধা ও মোবারকবাদ।
লেখক:
অধ্যক্ষ (সাবেক) জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদরাসা, চট্টগ্রাম।
Leave a Reply