নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
বর্হিনোঙ্গরে মাদার ভেসেল থেকে পণ্য আনলোড় করার উপর বিধিনিষেধ আরোপের ফলে কর্ণফুলী নদীর বুকে অলস বসে আছে দেড় হাজার বাল্কহেড (পণ্যবাহি জাহাজ)। ফলে প্রায় ৫ হাজার শ্রমিকের মানবেতর জীবন কাটছে। বাল্কহেড চলাচল করতে না পারায় ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না বাল্কাহেড মালিকরা। এর ফলে ঋণের বোঝায় দিশেহারা বাল্কহেড মালিক। অপরদিকে লাইটারেজের চেয়ে সাশ্রয়ী এ পরিবহন চলাচল করতে না পারায় আমদানিকারকদের চরম ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
বাল্কহেড ব্যবসায়ী এসোসিয়েশন অব চট্টগ্রাম সভাপতি মোহাম্মদ চান মিয়া বলেন,দীর্ঘ ৮ মাস ধরে মাদার ভেসেল থেকে পণ্য পরিবহনে নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রায় আড়াই হাজার বাল্কহেড অলস সময় পার করছে। ফলে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে ক্রয় করা বাল্কহেডগুলোর যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে পারে না। সহসা এ বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করা না হলে বাল্কহেড সহ সমস্ত নৌযানগুলোকে নিয়ে বৃহত্তর ধর্মঘটের ঘোষণা দিব।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি হওয়া কনটেইনারবিহীন পণ্যের (খাদ্যশস্য, সার, সিমেন্ট, ইস্পাত ও সিরামিকশিল্পের কাঁচামাল বড় জাহাজের হ্যাচ বা খোলে আনা হয়) ৭৪ শতাংশই বহির্নোঙরে খালাস করা হয়। এর পরিমাণ গত অর্থবছরে ছিল ৩ কোটি ৬৩ লাখ টন। চলতি বছরের প্রথম দিকে বাল্কহেড চলাচলে বিধিনিষেধ দেয়ায় পণ্যপরিবহন সংকটে আমদানিকারকদের বিরাট আর্থিক ক্ষতিরও মুখোমুখি হতে হচ্ছেন। পণ্য খালাসে বিলম্ব আর এবং প্রতি টনে ২-৩শ টাকা বেশি খরচের কারণে আমদানিকারকদের গত এক বছরে ক্ষতি হয়েছে ১ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা। এদিকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে বাধ্য হওয়ায় বিলম্বের জন্য জাহাজ কোম্পানিগুলো বিলম্ব ভাড়াও আদায় করছে আমদানীকারকদের কাছ থেকে। বাড়তি এসব ভাড়া পরিশোধ করতে হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রায়। এই সবকিছুর ফলে দেশের বাজারে আমদানীকৃত পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে এবং তার অর্থনৈতিক চাপ গিয়ে পড়ছে ভোক্তাসাধারণের ওপর।
কয়েক আমদারিক জানিয়েছেন, গত ৭/৮ মাস ধরে সাগরে নোঙর করা পণ্যবাহী বড় জাহাজ থেকে পণ্য খালাসে একটি চক্র বাল্কহেডগুলোকে বাধা দিচ্ছে। সাগরে বাল্কহেডগুলো মাদার ভ্যাসেল থেকে পণ্য ডেলিভারী নিতে অযোগ্য ঘোষণায় একটি চক্রের উন্ধন রয়েছে বলে অভিযোগ বাল্কহেড মালিকদের। চট্টগ্রামে লাইটার জাহাজও রয়েছে অল্প সংখ্যক। এ অবস্থায় বাল্কহেডগুলোকে মাদার ভ্যাসেল থেকে পণ্য ডেলিভারী নিতে বাধাঁ সৃষ্টির পর পুরো এ সেক্টরটি একটি চক্রের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। বড় জাহাজগুলো থেকে ১৮ দিনের মধ্যে পণ্য খালাসের কথা থাকলেও খালাসী জাহাজ সংকটে বিলম্ব হচ্ছে পণ্য খালাসে। ফলে জাহাজের টার্ন অ্যারাউন্ড টাইম বৃদ্ধি এবং ডেমারেজ চার্জসহ পণ্য আমদানি-রফতানি ব্যয় বাড়ছে।
আমদারিকারদের অভিযোগ, একটি চক্র সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে ভুল তথ্য দিয়ে সাশ্রয়ী পণ্য পরিবহন বাল্কহেড পরিচালনা কার্যক্রমের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে। তারা বলছেন, লাইটারের অর্ধেক ভাড়ায় বাল্কহেডে পণ্য পরিবহণে সুযোগ রয়েছে। যেখানে বাল্কহেডগুলোকে বড় জাহাজ থেকে পণ্য পরিবহণে বাঁধা দেওয়া বন্দরের সুনাম নিয়ে ষড়যন্ত্রের অংশ ছাড়া আর কিছুই নয়। পদ্মাসেতু নির্মাণে সমস্ত মালামাল বাল্কহেড দিয়ে পরিবহন হচ্ছে। ভারত থেকে পণ্য আমদানিতেও বাল্কহেড ব্যবহার করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের ড্রেজিংয়েও ব্যবহার হচ্ছে বাল্কহেড। অথচ বন্দর চ্যানেলে পণ্য পরিবহনে বাল্কহেড ব্যবহার করা যাবে না এমন সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী।
অনুসন্ধানে জানা যায়, পরিবহন এজেন্টরা বাল্কহেড দিয়ে বহির্নোঙর থেকে মাদার ভেসেলের পণ্য কম ভাড়ায় ব্যবহার করেন। কারণ হিসেবে এক আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ নির্বাহী জানান, দেশের সব এলাকায় লাইটার জাহাজ যেতে পারে না। বাঁশখালী এস.আলম পাওয়ার প্লান্ট, মঘনামা শেখ হাসিনা সাব মেরিন, কক্সবাজার বিমান বন্দর, কুতুবদিয়া, মাতারবাড়ি, ভাসান চর, সন্দ্বীপ, গুপ্তছড়া, নোয়াখালী মুছাপুর, কক্সবাজার রাবার ড্যাম এবং মিরেরসরাই অর্থনৈতিক জোনসহ যেসব স্থানে বিভিন্ন মেঘা প্রকল্পের কাজ চলছে সেখানে অবাধে যেতে পারে বাল্কহেড। তাছাড়া, লাইটার জাহাজের তুলনায় বাল্কহেডের ভাড়া একেবারে কম। এ কারণে বাল্কহেডের প্রতি আমদানিকারকদের নির্ভরশীলতা বেশি।
বাল্কহেড ব্যবসায়ী এসোসিয়েশন অব চট্টগ্রাম সহ-সভাপতি আমির হোসেন বলেন, চট্টগ্রামে প্রায় আড়াই হাজার বাল্কহেড রয়েছে। দেশের যেসব অঞ্চলে লাইটার ভেসেলের মাধ্যমে সরাসরি মালামাল পাঠানো যায় না, সেখানে বাল্কহেডের মাধ্যমে পণ্য পরিবহন করা হলে খরচ পড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা টনপ্রতি। তারস্থলে একবার লাইটার তারপর বাল্কহেডের মাধ্যমে পরিবহণ করা হয় সে ক্ষেত্রে অঞ্চলভেদে ৬০০ থেকে ৭০০টাকা বাড়তি খরচ পড়ে। একটি মাদার ভ্যাসেল একদিন অলস বসে থাকা মানে ১০-১৫ হাজার ডলার বাড়তি খরচ। বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় শুধু নয়, মেরিটাইম ওয়ার্ল্ডে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুন্ন হচ্ছে।
বাল্কহেড ব্যবসায়ী এসোসিয়েশন অব চট্টগ্রাম এর উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য নুরুন্নবী প্রকাশ নুরু ফকির বলেন, বাল্কহেড সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার (বে-ক্রসিং) উপযুক্ত নয় বলে মহলবিশেষের ষড়যন্ত্রের কারণে প্রশাসন নিষেজ্ঞা দেওয়ায় আমদানিকারকদের বিরাট আর্থিক ক্ষতিরও মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এতে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
Leave a Reply